করোনা মোকাবিলায় রোবট বানাল স্কুলছাত্র শাওন
অনেকেই সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে করোনা আক্রান্ত রোগীর কাছে যেতে চান না। আবার করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেক চিকিৎসক। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে রোবট উদ্ভাবন করেছে বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার দশম শ্রেণির ছাত্র শাওন সরদার সোলাইমান। তার উদ্ভাবিত রোবট করোনা রোগীর বেডের পাশে গিয়ে তার চিকিৎসায় প্রাথমিক পরামর্শ দিতে পারবে।
এছাড়াও রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ওঠানামা, রোগীর অবস্থান থেকে চিকিৎসক দূরবর্তী কোথাও থাকলে তাকে সরাসরি দেখাতে পারবে। রোগীর অবস্থান থেকে রোবটের পাঠানো তথ্যের ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসক নতুন কোনো পরামর্শ দিলে বা করোনা রোগী চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে রোবট কথা বলিয়ে দেবে।
বিজ্ঞাপন
করোনার এই দুঃসময় প্রযুক্তির মাধ্যমে মোকাবেলা করার চিন্তা থেকে এক বছর আগে রোবট বানানোর কাজে হাত দেয় শাওন। সে নিজের উদ্ভাবিত রোবটের নাম দিয়েছে ‘মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট’।
শাওন জানায়, মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট তৈরির কাজ প্রায় শেষ। এখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে যেন করোনার চিকিৎসা দিতে পারে সেই প্রযুক্তি উন্নয়নে কাজ করছেন। এতে করে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকবে না। সেই সঙ্গে চিকিৎসকরাও ঝুঁকিমুক্ত থাকবেন।
আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র শাওন সিকদারের বাড়ি উপজেলার ভদ্রপাড়ায়। তার বাবা দেলোয়ার সরদার স্থানীয় বাজারে জুতার ব্যবসা করেন। শারীরিকভাবে আংশিক প্রতিবন্ধী দেলোয়ার ছেলের উদ্ভাবন দেখে খুশি হলেও মনে আফসোসও আছে তার।
দেলোয়ার বলেন, ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নিয়ে নতুন কিছু তৈরি করার চেষ্টা করতো শাওন। নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর থেকেই নিজে নিজে বলতো সে রোবট তৈরি করবে। আমরা তখন বিষয়টি হাস্যরস করে উড়িয়ে দিতাম। কিন্তু ওর স্কুলে যাওয়ার জন্য যে হাত খরচ দিতাম সেই টাকা জমিয়ে দিনে দিনে দেখছি বিভিন্ন যন্ত্রাংশ দিয়ে একটি রোবট তেরি করেছে।
তিনি আরও বলেন, শাওনের রোবট সব ভাষায় কথা বলতে পারে। এর সব সিস্টেমই মোবাইল দিয়ে করেছে সে। তবে আমার আফসোস ছেলেকে একটা কম্পিউটার কিনে দিতে পারিনি। পারলে আরও দারুণ কিছু আবিষ্কার করতে পারতো।
শাওন বলে, ২০২০ সালের মার্চ মাসে চূড়ান্তভাবে রোবট বানানোর কাজ শুরু করি। আমি মূলত ভিন্ন কিছু নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছি। যে রোবট আমাদের বড় ধরণের সমস্যার সমাধান করতে পারবে তা নিয়েই কাজ করছি। গত বছরের মার্চ মাসে যখন করোনা সংক্রমণ শুরু হয় তখন মা ছেলের কাছে যান না, ছেলে মা-বাবাকে ফেলে রেখে যান এমন অনেক খবর পাই। তখনই সিদ্ধান্ত নিই আমি করোনা প্রতিরোধে রোবট তৈরি করবো। এরপর অনলাইনে রোবট উদ্ভাবনের ভিডিও দেখে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টের সিস্টেম ডেভেলপ করতে শুরু করি।
সে জানায়, পরিবার থেকে বিশেষ কোনো সহায়তা পায়নি। যা করেছে তা নিজের চেষ্টায়। মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টের সিস্টেম ডেভেলপ করলে দেশে করোনা মোকাবেলায় এটি কাজে আসবে।
তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় শাওন। বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার সুবাদে রোবট উদ্ভাবনের চিন্তা মাথায় আসে তার। ভবিষ্যতে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হতে চায় শাওন।
শুধু শাওন সরদারই নয়, ১২৮ বছরের ঐতিহ্যবাহী গৈলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের আরও দুই ছাত্র ইতোমধ্যে ‘রবিন’ ও ‘বঙ্গ’ নামে দুটি স্বয়ংক্রিয় রোবট উদ্ভাবন করে যথারীতি হৈ-চৈ ফেলে দিয়েছে বলে জানান বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. জহিরুল হক।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র শুভ কর্মকার ২০১৮ সালে উদ্ভাবন করে বাংলা ও ইংরেজিতে কথা বলা রোবট রবিন। ওই একই শিক্ষাবর্ষের ছাত্র সুজন পাল চলতি বছরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষের মাসে উদ্ভাবন করে বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দিতে কথা বলতে পারা রোবট।
প্রধান শিক্ষক মো. জহিরুল হক বলেন, ঐতিহ্যবাহী এই বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শিক্ষা ও চর্চার ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করছি। যে কারণে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিভা বিকশিত করতে পারছে। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে অবদান রাখছে। ওদের উদ্ভাবন ও এগিয়ে যাওয়ায় আমরা গর্বিত।
‘রবিন’র উদ্ভাবকের হাতে আরও দুই রোবট
কথা হয় সন্তোষ কর্মকারের ছেলে শুভ কর্মকারের সঙ্গে। ২০১৮ সালে তার উদ্ভাবিত রোবট ‘রবিন’ চমকে দিয়েছিল দেশকে। সে বলে, রোবট সোফিয়াকে যখন বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয় তখন দেখলাম সোফিয়া ইংরেজিতে কথা বলতে পারে। আমি চিন্তা করলাম সোফিয়া যদি ইংরেজিতে কথা বলতে পারে তাহলে অন্য রোবট বাংলায়ও কথা বলতে পারবে। সেই চিন্তা থেকে নিজেই রোবট তৈরিতে হাত দেই। আমার উদ্ভাবিত রবিন গ্যাস লিকেজ, অগ্নিকাণ্ড কিংবা দুর্ঘটনার খবর আমার কাছে ও নিকটস্থ সংশ্লিষ্ট দফতরে সিগন্যাল পাঠিয়ে জানাতে পারবে। রোবট সোফিয়া তৈরিতে অনেক খরচ হয়েছে। কিন্তু আমার চেষ্টা ছিল খরচ কমিয়ে মানুষের উপকারী রোবট তৈরি করা।
বর্তমানে বরিশাল অমৃত লাল দে কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী শুভ কর্মকার বলে, রবিনকে ২৫-৩০ হাজার টাকার মধ্যে তৈরি করেছিলাম। তখন রবিন চাকার মাধ্যমে চলাচল করতে পারতো। এখন আমি রবিনের প্রযুক্তি ডেভেলপ করছি। যেন পা ফেলে চলাচল করতে পারে। বস্তু এক স্থান থেকে অন্য স্থানে আনা নেওয়া করতে পারে।
রোবট রবিন হচ্ছে সেলফ লার্নিং রোবট। তার মধ্যে কম্পিউটারাইজড সিস্টেমের মাইক্রো প্রসেসর আছে। এর মাধ্যমে সে যেকোনো ধরনের প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারে। শিক্ষক, বন্ধু বা অবসরকালীন সঙ্গী হিসেবে সময় কাটানোর জন্যও রবিনকে ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া মাল্টিলেভেল প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তার জন্যও রোবট রবিন অত্যন্ত কার্যকর।
শুভ কর্মকার জানায়, রবিনের পাশাপাশি আরও দুটি রোবট তৈরিতে সে কাজ করছে। যার থ্রিডি কাঠামো তৈরি শেষ। খুব শিগগিরই অবকাঠামো বাস্তবায়নে হাত দেওয়া হবে।
২০১৮ সালের ১৫ মে জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের উদ্ভাবন বিষয়ক জাতীয় পর্যায়ে দ্বিতীয় হয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছ থেকে পুরস্কার লাভ করেন রবিনের উদ্ভাবক শুভ কর্মকার। এরপর সে ২০১৯ সালের ২৭ জুন ৪০তম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের হাত থেকে পুরস্কার নেয়। এছাড়াও সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ-২০১৯
এ বিজ্ঞান বিষয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে ১ম হয়ে জাতীয় পর্যায়ে অংশ নিয়ে ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির হাত থেকে ‘বছরের সেরা মেধাবী’ পুরস্কার নেয় শুভ কর্মকার।
সুজনের ‘বঙ্গ’ বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায়ও কথা বলে
শিহিপাশা গ্রামের পালপাড়ার জয়দেব চন্দ্র পাল রোবট কী তা এক মাস আগেও বুঝতেন না। তার নিজের হাতে তৈরি করা বিভিন্ন মূর্তি রঙে রঙিন হলেও কখনো কথা বলতে শোনেননি। কিন্তু তার ছোট ছেলে সুজন পালের তৈরি প্লাস্টিকের মানব মূর্তি বা রোবট যখন বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দিতে কথা বলতে পারছে তখন চমকে গেছে পুরো দেশের মানুষ। তার ছেলে সুজনও গৈলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। বর্তমানে গৌরনদী সরকারি ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র সে। তারও নিজের কম্পিউটার নেই। এসএসসিতে পাস করায় পরিবার থেকে স্মার্টফোন কিনে দেওয়ায় সেটি দিয়েই কাজ করেছেন প্রগ্রামিংয়ের।
সুজন বলে, বিদেশি রোবট সোফিয়াকে দেশে নিয়ে আসায় আমি রোবট সর্ম্পকে জানতে পারি। আমারও মনে আশা জাগে রোবট তৈরি করার। সেই চিন্তা থেকে কাজ শুরু করি। যেহেতু আমার রোবট বাংলায় কথা বলতে পারে এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে ২১ মার্চ তৈরি শেষ হয় তাই ওর নাম দিয়েছি ‘বঙ্গ’। বঙ্গ শুধু যে বাংলায় কথা বলতে পারে তা কিন্তু না, ইংরেজি, হিন্দি এমনকি বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায়ও কথা বলতে পারে।
সে বলে, বঙ্গকে আরও আধুনিক করার জন্য কাজ করছি। যেন এক স্থানের বস্তু অন্য স্থানে নিতে পারে বা কারও সঙ্গে একবার দেখা হলে পরবর্তীতে অন্য কোথাও দেখা হলে তার পরিচয় জানাতে পারে ও কুশল বিনিময় করতে পারে।
করোনা প্রতিরোধে বঙ্গ স্বয়ংক্রিয়ভাবে মানুষকে সতর্ক করছে উল্লেখ করে সুজন বলে, রোবট তৈরির শুরুটা আমি ইউটিউবে দেখে শুরু করি। আমার ইচ্ছা বঙ্গ সবার উপকারে আসবে এবং আমি সেই সিস্টেম ডেভেলপে কাজ করছি।
সুজনের বাবা জয়দেব চন্দ্র পাল বলেন, দুই-তিন মাস ধরে ওর লেখাপড়ার কোনো শব্দ পেতাম না। জানতে চাইলে কিছু বলতোও না। পরে দেখি সে রোবট তৈরি করছে। এখন আমার ভালো লাগছে, অনেক মানুষ আসে আমাদের বাড়িতে। আমি চাই আমার ছেলে দেশের জন্য কাজ করবে। একজন বিজ্ঞানী হবে।
এ বিষয়ে আগৈলঝাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল হাশেম বলেন, উপজেলায় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। এটি আনন্দের সংবাদ। আমরাও তাদের সহায়তা করতে চাই। এইসব ক্ষুদে প্রযুক্তিবিদরা এক সময়ে বড় বিজ্ঞানী হবে বলে আমার বিশ্বাস। যারা রোবট নিয়ে কাজ করছে তারা সহায়তার আবেদন করলে আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সহায়তার চেষ্টা করব।
আরএআর