চারিদিকে বৈশাখী উৎসবের আমেজ। এমন সময় বগুড়ার হরিপুরের কারিগরপাড়ায় রঞ্জিত, সুজনদের ঘরে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তারা তৈরি করছেন কদমা, ছাচ, খাগড়াই, বাতাসাসহ মজাদার মিঠাই।

বগুড়া সদরের নুনগোলা ইউনিয়নে অবস্থিত এই হরিপুর গ্রাম। গত ৩০ বছর ধরে রঞ্জিত চন্দ্র দাস তার ভাই, ভাতিজাসহ ১৬ জন মিঠাই তৈরি করে সংসার চালাচ্ছেন। বাংলাসনের আশ্বিন থেকে শুরু করে জৈষ্ঠ্য মাস পর্যন্ত চলে তাদের এই মিঠাই উৎপাদনের কর্মযজ্ঞ। শুধু বর্ষার চার মাস বন্ধ থাকে কারখানা।

গতকাল শনিবার (১৩ এপ্রিল) কারখানায় গিয়ে দেখা যায় উঠানের মাঝে চারটি চুলা বসানো। তাতে গরম করা হচ্ছে চিনির শিরা। এই শিরাগুলো দিয়ে কেউ তৈরি করছেন ছাচের হাতি-ঘোড়া, মাছ ও রকমারি ফুলের আকৃতি। আরেক জন তৈরি করছেন কদমা। কেউবা বসে থেকে বানাচ্ছেন খাগড়াই।

কারিগররা জানান, মিঠাই খাবারগুলো উৎপাদনের একমাত্র উপাদান চিনি। সাধারণত দৈনিক ১০ বস্তা (৫০ কেজি) চিনির মিঠাই উৎপাদন করা হয়। তবে বৈশাখকে কেন্দ্র করে এখন প্রতিদিন অন্তত ২০ বস্তা চিনির মিঠাই সামগ্রী তৈরি করছেন তারা।  

তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে কারিগরা জানান, কড়াইয়ে গরম পানিতে চিনি ঢেলে জ্বাল দিয়ে শিরা করেন কারিগররা। পরে সেগুলো কাঠির সঙ্গে টেনে টেনে খামির তৈরি করা হয়। এরপর সুতায় কেটে প্রস্তুত হয় গোলগোল কদমা। আর মাছ, হাতি, ঘোড়ার জন্য ব্যবহার হয় কাঠের ছাচ। এ জন্য এগুলোর নামও চিনির ছাচ।    

উঠানের এক পাশে চিনির শিরা জ্বাল দিচ্ছিলেন তপন কুমার দাস। জানালেন, এক কড়াই গরম পানিতে ১০ কেজি চিনি দেওয়া হয়। জ্বাল দেয়ার পর সেখান থেকে ২০০ গ্রাম কমে যায়। ৮০০ গ্রাম কদম, ছাচ পাওয়া যায়।  

জ্বাল দেওয়া শিরাকে ঢালাই করা পাটাতনে রেখে দেওয়া হয়। সেগুলো একটু ঠাণ্ডা হয়ে এলে হাতে বিশেষ পদ্ধতিতে টেনে লই বা খামির বানানো হয়। কোকিল চন্দ্র দাস বলেন, চিনির লই বানানোর পর হালকা গরম থাকতেই এটাকে কেটে কদমা তৈরি হয়। ঠাণ্ডা হয়ে গেলে আর কিছু বানানো যায় না।

কারিগরদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, রঞ্জিত চন্দ্র দাসের হাত ধরে তারা কদমা, খাগড়াই বানানো শুরু করেন। এখন ব্যবসা পরিচালনা করছেন সুজন চন্দ্র দাস। হরিপুরের এসব মিঠাই বগুড়ার সব উপজেলায় সরবরাহ করা হয়। বগুড়া ছাড়াও পার্শ্ববর্তী জেলার যেকোনো ধরনের মেলার জন্য ব্যবসায়ীরা তাদের কাছে থেকে ক্রয় করে নিয়ে যায়।

আশ্বিন মাসের পর থেকে বিভিন্ন স্থানে মেলা শুরু হয়। তখন থেকে তাদের কাজের মৌসুম। একেবারে চলে জেষ্ঠ্য মাস পর্যন্ত। এরপর তারা হিসেব-নিকেশ করে মুনাফা ভাগাভাগি করেন। এতে প্রতি বছর গড়ে একেকজন প্রায় তিন লাখ টাকা করে পেয়ে থাকেন।

উত্তম চন্দ্র দাস নামে এক কারিগর বলেন, আমরা সকাল ৭টা থেকে শুরু করি। রাত ১০টায় কাজ শেষ হয়। এর মধ্যে যার যার বাড়ি গিয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিই। বছর শেষে আমরা ১৬ জন টাকা ভাগ করে নিই। আমরা ইতিমধ্যে দেড় লাখ করে টাকা পেয়েছি। এখন যেমন অবস্থা দেখছি, তাতে আশা করছি বৈশাখ শেষে সবমিলে তিন লাখ টাকা আয় হবে।

মিঠাই কেনার সময় কথা হয় শিবগঞ্জ উপজেলার মহাস্থানগড় এলাকার ব্যবসায়ী আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রায় ১০-১২ বছর ধরে হরিপুর গ্রাম থেকে মিঠাই কিনি। এগুলো নিয়ে বিভিন্ন স্থানে মেলায় নিয়ে যাই। আবার মহাস্থানহাট এলাকায় আমার মিষ্টির দোকান আছে। সেখান থেকেও বিক্রি হয়।  
 
শুরুর গল্প নিয়ে রঞ্জিত চন্দ্র দাস জানান, আগে তারা ঝুড়ি, মুড়কি, মোয়া বানিয়ে বিক্রি করতেন। ওই সময় সেগুলো তেমন চলতো না। পরে ১৯৯২ সালের দিকে জয়পুরহাটের পাঁচবিবি থেকে কদমা, বাতাসা কিনে আনা শুরু করেন। চাহিদা ভালো থাকায় এর দু বছর নিজে তৈরি করার উদ্যোগ নেন। তারপর থেকে চলছে কদমা-খাগড়াইয়ের উৎপাদন। এখন প্রতিদিন গড়ে ১০ মণ কদমা, ১০ ছাচ ও ৫ মণ খাগড়াই বানানো হচ্ছে।

রঞ্জিত চন্দ্র দাস বলেন, সে সময় লাভের পরিমাণটা ভালো থাকায় এ ব্যবসা শুরু করেছিলাম। প্রায় ৩০ বছর হয়ে গেল। এখন অনেক স্থান থেকে মাল ক্রয় করতে আসে। অনেকে চেনে।

এই কদম, খাগড়াই তৈরি থেকে আয়ে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা করাচ্ছেন। বড় ছেলে বিএ (সম্মান) পড়ছেন। মেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে বলে জানান রঞ্জিত। তবে অনেক পরিশ্রমের কাজ হওয়ায় তিনি চাননা এই পেশায় তারা আসুক।

আসাফ-উদ-দৌলা নিওন/এএএ