সুলতানি ও মোগল আমলের নকশার মিশেলে মুসলিম স্থাপত্যের যে কটি নিদর্শন বাংলাদেশে দেখা মিলে তার মধ্যে বগুড়ার খেরুয়া মসজিদ অন্যতম। ঐতিহ্যবাহী মসজিদটিতে আজও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় মসজিদের নির্মাণশৈলীর পাশাপাশি আধ্যাত্মিক গল্প এর আকর্ষণ আরও বাড়িয়েছে।

বগুড়া শহর থেকে ২৩ কিলোমিটার দক্ষিণে শেরপুর উপজেলার খন্দকারটোলা গ্রামে মসজিদটির অবস্থান। মসজিদের গায়ে থাকা শিলালিপি থেকে জানা যায়, ১৫৮২ সালের ২১ জানুয়ারি (৯৮৯ হিজরির ২৬ জিলহজ্জ) মসজিদটির নির্মাণ শুরু হয়।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্র বলছে, সঠিক তারিখ সংবলিত এ অঞ্চলের মুসলিম আমলের সবচেয়ে প্রাচীন কীর্তি এটি। আরব দেশ থেকে আব্দুস সামাদ ফকির নামের এক ব্যক্তি শেরপুরের এ এলাকায় এসেছিলেন। এলাকাটি ঘনবসতি হওয়ায় তিনি এখানে একটি মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। তখন এ অঞ্চলের শাসক জওহর আলী কাকশালের ছেলে মীর্জা মুরাদ খানের সহায়তায় মসজিদটি নির্মাণ হয়।

খেরুয়া মসজিদের গায়ে স্থাপিত শিলালিপি থেকে জানা যায়, মসজিদের নির্মাণকাজ ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়। এ মসজিদের নির্মাণকাজ শেষ করতে আরও কয়েক বছর সময় লেগেছিল বলে ধারণা করা যায়। ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ হয় তাতে বিহার ও বাংলা সাময়িকভাবে সম্রাটের হস্তচ্যুত হয়।

সে সময়ে কাকশাল উপাধিধারী তুর্কি জায়গীরদারগণের অধীনে ছিল ঘোড়াঘাট অঞ্চল। তারাও বিদ্রোহী হয়ে মাসুম খান কাবুলীর সঙ্গে যোগদান করেন। ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে খান-ই-আযম বাংলার সুবেদার নিযুক্ত হয়ে নানারকম প্রলোভনে ভুলিয়ে কাকশাল নেতাদের বশীভূত করেন। এতে বিদ্রোহী মাসুম খান কাবুলি কাকশালদের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যে তাদের আবাসস্থল ঘোড়াঘাট আক্রমণ ও অবরোধ করেন। পরে খান-ই-আযম প্রায় চার হাজার অশ্বারোহী সৈন্য পাঠিয়ে কাকশালদের বিপদমুক্ত করেন।

এতে দেখা যায়, ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে মসজিদের কাজ আরম্ভ হওয়ার সময় মসজিদ নির্মাতা নওয়াব মীর্যা মুরাদ খান বিদ্রোহীদের দলভুক্ত ছিলেন। পরবর্তী বছরে অন্যান্য কাকশাল নেতার সঙ্গে তিনিও খুব সম্ভব সম্রাটের আনুগত্য স্বীকার করেন। মীর্যা মুরাদ খানের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায়নি। তিনি খুব সম্ভব শেরপুর মুরচার জায়গীরদার বা ফৌজদার ছিলেন। এ সময় শেরপুর মুরচা ঘোড়াঘাটের অধীনে একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল।

মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী সম্পর্কে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তথ্য বলছে, প্রাচীন এই মসজিদটি চার কোণের প্রকাণ্ড আকারের মিনার আর চওড়া দেওয়ালে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। উত্তর-দক্ষিণ লম্বা বিশিষ্ট মসজিদটির বাইরের দিকের দৈর্ঘ্য ৫৭ ফুট এবং প্রস্থ ২৪ ফুট। ভেতরের দিকের দৈর্ঘ্য ৪৫ ফুট ও প্রস্থ ১২ ফুট। আর মসজিদের চারদিকের দেওয়ালের পুরুত্ব ৬ ফুট।

এই মসজিদ নির্মাণে ইট, চুন ও সুরকি ছাড়াও বৃহদাকার কৃষ্ণ পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। তিন গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদের চারকোণায় চারটি মিনার ও পূর্ব দেওয়ালে তিনটিসহ উত্তর-দক্ষিণে আরও দুটি দরজা রয়েছে। আর পশ্চিম দেয়ালে আছে তিনটি কারুকার্য করা মিহরাব। এ ছাড়া ধনুকের মতো বাঁকা কার্নিশের তলায় সারিবদ্ধ খিলান আকৃতির প্যানেলের আছে চমৎকার অলংকরণ।

ইটের বিন্যাস ও খাড়া প্যানেলের মাধ্যমে নান্দনিক বৈচিত্র্য তৈরি করা হয়েছে। মিনার, গম্বুজ ও ইটের বৈচিত্র্যময় গাঁথুনি এবং ফুল-লতা-পাতার নকশা পুরো মসজিদটিকে দিয়েছে বিশেষ স্বতন্ত্রতা। মসজিদের সামনের দেওয়ালে স্থাপিত ফারসি শিলালিপি। এই শিলালিপিতে খোদাই করা কথাগুলোর বাংলা তরজমা করলে কিছু আধ্যাত্মিক অর্থ দেখা যায়। যেমন আবদুস সামাদ ফকির তিনি কবুতরদের সঙ্গে কথা বলতেন। মসজিদ নির্মাণের জন্য স্থান নির্ধারণের সময় দুটি কবুতর এসে মাটিতে নামে। তারা ও তাদের পরবর্তী বন্ধুদের মসজিদে বসবাসের জন্য আবদুস সামাদ ফকিরের কাছে স্থান দাবি করে। এই শিলালিপিতে তাই কবুতরদের বসবাসের জন্য নির্দেশনা উল্লেখ করা আছে। সেই সঙ্গে তাদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সতর্কবাণী জানানো হয়।

মসজিদ প্রাঙ্গণে আবদুস সামাদ ফকিরের কবর দেওয়া হয়। তবে তার মৃত্যুর সময়কাল কেউ বলতে পারেনি। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের খেরুয়া মসজিদের কেয়ারটেকার আবদুস সামাদ প্রামানিক এই কথা জানান। তিনি এই মসজিদে ১৯৮৮ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করছেন।

আবদুস সামাদ প্রামানিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আব্দুস সামাদ ফকির অনেক কামেল ব্যক্তি ছিলেন। তার সঙ্গে কবুতর কথা বলত। মসজিদ বানানোর আগে দুটি কবুতর তাকে বলে, আপনি মসজিদ বানাচ্ছেন আমাদেরও ইবাদত করার জায়গা দেন। তখন তিনি বলেন, না তোমাদের জায়গা দিলে নানা অসুবিধা হবে। এরপরও আলোচনার পর কবুতরদের মসজিদের দক্ষিণ-উত্তর ও পশ্চিম এই তিন পাশে থাকার জায়গা করে দেন। এরপর সেখানে নামাজ আদায় হত। এই কথা মসজিদের শিলালিপিতে লেখা আছে। এখন অবশ্য মসজিদে কোনো কবুতর থাকে না। কবুতরগুলো শাহজাদপুরে চলে গেছে। এগুলোর জায়গায় সারক (শালিক) পাখি আবাস নিয়েছে।

জনশ্রুতি

স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, এই মসজিদকে ঘিরে মিথ (জনশ্রুতি) রয়েছে যে এক রাতে জিন এই মসজিদ নির্মাণ করেছে। শিলালিপির কবুতরদের বাস করার নির্দেশনা এই জনশ্রুতিকে আরও বেশি যেন টেকসই করেছে। ফলে মসজিদ নিয়ে স্থানীয়দের কাছে যেমন শ্রদ্ধার তেমনি ভয়ের স্থান। দীর্ঘদিন এই মসজিদ এলাকাটি জঙ্গলে ভরপুর ছিল। ১৯৫৬ সালে মসজিদটি সরকারিভাবে পুরাকীর্তি হিসেবে মেরামত করা হয়। পরবর্তীতে মসজিদ বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় নিয়ে আসা হয়। এখন মসজিদটি ব্যবহারের উপযোগী হলেও সেই ভয় থেকে অনেকে এখনো খেরুয়া মসজিদে নামাজ পড়তে ভয় পান।

খন্দকার টোলা গ্রামের আমজাদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই মসজিদের অনেক বয়স, প্রায় সাড়ে চারশ বছর। আগে এখানে লোকজন এলেও নামাজ পড়ত না। আমরা দাদা-বাবার কাছে শুনেছি এই মসজিদে জিন-পরীরা নামাজ পড়তেন। এখন অবশ্য এখানে নামাজ হয়। ঈদের নামাজও পড়তে আসে মানুষজন।

একই গ্রামের আব্দুল খালেক বলেন, আমরা গল্প শুনেছি এই মসজিদের গায়ে অনেক দামি জিনিসপত্র ছিল। এই যেমন স্বর্ণালঙ্কারের মতো। কিন্তু কালক্রমে সেগুলো আর নেই। এখন আমরা তো দাদা-বাবার কাছে শুনেছি মসজিদ নির্মাণে জিনেরা ছিল। বিশ্বাস না করাও ঠিক হবে না। যেহেতু আমরা দেখিনি। হয়তো হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে।

তবে এমন জনশ্রুতির বিষয়টি পুরোটাই ভিত্তিহীন বলেছেন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের লোকজন। কেয়ারটেকার আব্দুস সামাদ প্রামাণিকের ভাষ্য, এটা ভুয়া কথা। মানুষের হাতে মসজিদ বানানোর বিষয়টি তো শিলালিপিতেই বর্ণনা করা আছে।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, মসজিদটি এখন সম্পূর্ণ পরিচ্ছন্ন। রাস্তাসহ ৫৯ শতক জায়গা নিয়ে অবস্থিত খেরুয়া মসজিদের সামনের অংশে রয়েছে আয়তাকার মাঠ আর মসজিদের চতুর্দিকে রয়েছে তাল, নারকেল, আম এবং কদম গাছের সারি। মসজিদের উত্তর পাশে ওজুর স্থান। ছাদের দিকে ছোট খোপগুলোয় শালিক পাখির আনাগোনা। বিকেল হতেই দর্শনার্থীরা চলে এসেছেন ঐতিহাসিক এই মসজিদটি ঘুরে দেখতে।

মসজিদ কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রতিদিন গড়ে ২৫ থেকে ৩০ জন দর্শনার্থী বেড়াতে আসেন। তবে শুক্রবার ও শনিবার বেশি হয়। এই দুই দিনে ১৫০ থেকে ২০০ জন মানুষ আসেন খেরুয়া মসজিদ দেখতে।

শেরপুর উপজেলার ধুনট মোড় থেকে বান্ধবীদের নিয়ে বেড়াতে এসেছেন রোশনী আক্তার। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আজকে আবহাওয়া ভালো ছিল তাই এখানে এসেছি ঘুরতে। ছবি তুলব। খুবই ভালো লাগছে।

দীর্ঘদিনে সংস্কার নেই মসজিদে

২০১৮ সাল থেকে মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে দায়িত্বে আছেন একই এলাকার জুবায়ের আহমেদ। নিজ এলাকায় এবং ঐতিহাসিক মসজিদে আজান দেওয়ার দায়িত্ব পেয়ে যেমন খুশি তেমনি গর্বিতও তিনি। ঢাকা পোস্টকে জানালেন, মসজিতের ভেতরে তিনটি কাতার হয়। প্রতি কাতারে ৩০ জন করে মোট ৯০ জন মানুষ নামাজ পড়তে পারেন। শুক্রবার বাইরেও নামাজের আয়োজন করা হয়।

জুবায়ের আহমেদ বলেন, বৃষ্টির দিনগুলোতে শুক্রবারের জামাতে মুসল্লিদের কষ্ট হয়। কেননা মসজিদের ভেতরে বৃষ্টির সময় প্রচুর পানি পড়ে। পানি পড়ার কারণে এটি ধ্বংসও হতে পারে। এগুলোর দ্রুত সংস্কারের দাবি জানাচ্ছি।

নামকরণ যেভাবে

এ মসজিদের ‘খেরুয়া’ নামের কোনো ইতিবৃত্ত পাওয়া যায়নি। আরবি বা ফারসি ভাষায় খেরুয়া বলে কোনো শব্দ দেখা যায় না। তবে ফারসি ভাষায় ‘খায়ের গাহ’ (The interior of a house) বলে একটি শব্দ ‘কোনো স্থানের অভ্যন্তরে বা নিকটে’ অর্থে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। এ মসজিদ যদি শেরপুর দুর্গের অভ্যন্তরে নির্মিত হয়ে থাকে তবে ‘খয়ের গাহ্’ থেকে খেরুয়া নাম হওয়া বিচিত্র নয়।

এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন বগুড়া প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ড. আহমেদ আবদুল্লাহ।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বগুড়াকে ইতিহাসের আকর হিসেবে ধরা হয়। তারই এক নিদর্শন শেরপুরের খেরুয়া মসজিদ। খেরুয়া মসজিদ সুলতানি আমলের শেষের দিকে আর মোগল আমলের শুরুর দিকে নির্মাণ করা হয়। এটাতে সুলতানি আর মোগলদের নির্মাণশৈলী দেখা যায়। ফারসি ভাষায় খেরুয়া বলে কোনো শব্দ নেই। খায়ের গাহ শব্দ রয়েছে। খায়ের গাহ বলতে বোঝায় কোনো কিছুর নিকটে। সেখান থেকে খেরুয়া শব্দ এসেছে বলে ধারণা করা যায়।

মসজিদটির সংস্কার নিয়ে সহকারী পরিচালক বলেন, আসলে দেশে আমাদের ছয় হাজারের বেশি প্রত্নতাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠান। আমাদের জনবল ও আর্থিক অসংগতি রয়েছে। খেরুয়া মসজিদে বেশ কয়েকবার কাজ হয়েছে। হয়ত মাঝে কিছুদিন কাজ হয়নি। আমরা আগামীতে মসজিদের কী সমস্যা আছে সেদিকে নজর দেব।

এমজেইউ