এক গ্রাহক ও দালালের সঙ্গে কথা বলছেন মোটরযান পরিদর্শক মেহেদী হাসান

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) শরীয়তপুর অফিসে দালালের মাধ্যমে ঘুষ নিয়ে সেবা দেওয়ার অভিযোগে আড়াই মাস আগে অভিযান পরিচালনা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ সময় দুদকের কর্মকর্তারা এক দালালকে হাতেনাতে আটকের পর দালালের সঙ্গে মোটরযান পরিদর্শক মেহেদী হাসানের সম্পৃক্ততা পেয়ে দুইজনকেই জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তাদেরকে সতর্কও করা হয়। কিন্তু এরপরও মোটরযান পরিদর্শক মেহেদী হাসানের ছত্রছায়ায় কমেনি দালালের দৌরাত্ম্য। এতে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন সেবাপ্রার্থীরা।

গতকাল বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) দুপুর ২টার দিকে বিআরটিএ শরীয়তপুর অফিসে গিয়ে মোটরযান পরিদর্শক মেহেদী হাসানের ছত্রছায়ায় দালালের এমন দৌরাত্ম্য দেখা গেছে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত ১৫ জানুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশন মাদারীপুরের সমন্বিত জেলা কার্যালয় বিআরটিএ শরীয়তপুর অফিসে গ্রাহক হয়রানির অভিযোগে অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানের সময় দুদকের কাছে গোসাইরহাটের কাওসার হাওলাদার নামে এক গ্রাহক অভিযোগ করে ওবায়দুল নামে এক ব্যক্তি বিআরটিএ অফিসের স্টাফ পরিচয় দিয়ে তার থেকে ৭ হাজার টাকা নিয়েছে। এরপর দুদক ওই দালালকে আটক করে। এ সময় ওই দালাল জানায় বিআরটিএ শরীয়তপুরের মোটরযান পরিদর্শক মেহেদী হাসানের সঙ্গে দালালদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। 

পরে দুদক তাদের দুইজনকেই জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আটককৃত দালাল ওবায়দুলকে ছেড়ে দেয়। এরপর ওবায়দুল বিআরটিএ শরীয়তপুরের কর্মকর্তারা কীভাবে দালালদের মাধ্যমে সেবাগ্রহীতাদের থেকে ঘুষ নিয়ে ভাগাভাগি করে তার স্বীকারোক্তি দেয় গণমাধ্যমে। এ ঘটনার তিন মাস পার হওয়ার আগেই মোটরযান পরিদর্শক মেহেদী হাসানের ছত্রছায়ায় বিআরটিএ অফিসে আবারও দালালদের দৌরাত্ম্যে হয়রানির শিকার হচ্ছেন গ্রাহকরা। 

বৃহস্পতিবার দুপুরে বিআরটিএ অফিসের বারান্দায় দেখা যায়, এক গ্রাহক ও দালাল নজরুল একটি মোটরসাইকেলের পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। এর কয়েক মিনিটের মধ্যে সেখানে উপস্থিত হন মোটরযান পরিদর্শক মেহেদী হাসান। এরপর গ্রাহক, দালাল নজরুল ও মেহেদী হাসান অফিসের ভেতরে প্রবেশ করেন। গণমাধ্যমকর্মীরা অফিসের ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা যায়, দালাল নজরুল অফিসের স্টোর রুমে ঢুকে বিভিন্ন নথিপত্র ঘেঁটে দেখছেন। এ সময় ওই গ্রাহককে মোটরযান পরিদর্শক মেহেদী হাসানের সঙ্গে তার কক্ষে দেখা যায়। গণমাধ্যমকর্মীদের উপস্থিতি টের পেয়ে এ সময় দালাল নজরুল অফিসের বাইরে চলে যান।

মারুফ পারভেজ সাইম নামে এক গ্রাহক ঢাকা পোস্টকে বলেন, নজরুল ভাইকে তো আমরা অফিসের স্টাফ হিসেবে চিনতাম, উনি যে দালাল তা জানা ছিল না আমার। বিআরটিএ লাইসেন্স দেবে আর ঘুষ দিতে হবে না, এটা কল্পনাও করা যায় না। এক দালাল ধরা খেলে আরেক দালাল আসে। লাইসেন্সের জন্য আসছিলাম, কিন্তু দালালরা যে টাকা চেয়েছে আমার কাছে, সেই টাকা নেই আমার। এখন বৈধ পথে ঘুরে দেখি কী হয়।

আপনার কাছে নজরুল কেন এসেছে এমন প্রশ্নের উত্তরে বিআরটিএ শরীয়তপুরের মোটরযান পরিদর্শক মেহেদী হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, নজরুল গ্রাহক হিসেবে এসেছে। কোনো গ্রাহক অফিসের স্টোর রুমে ঢুকতে পারেন কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি কোনো জবাব না দিয়ে চুপ থাকেন। 

আপনার সামনে বসা গ্রাহক, নজরুল দালাল ও আপনি এক সঙ্গে অফিসের বারান্দা থেকে ভেতরে প্রবেশ করলেন। বিষয়টি আসলে কী? এমন প্রশ্নের উত্তরেও তিনি চুপ থাকেন। পরে তিনি বলেন, এসব বিষয় নিয়ে আপনি অফিস প্রধানের সঙ্গে কথা বলুন।

অফিস প্রধান অফিসে উপস্থিত নেই জানালে তিনি বলেন, অপেক্ষা করুন। তিনি যেদিন আসবেন, সেদিন কথা বলিয়েন। 

এরপর গণমাধ্যকর্মীরা অফিস প্রধানের মোবাইল নম্বর চাইলে মেহেদী হাসান বলেন, আমার কাছে নেই, ওয়েবসাইটে দেখে নিন।

বিষয়টি নিয়ে বিআরটিএ শরীয়তপুরের সহকারী পরিচালক (অতিরিক্ত) মো. নুরুল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুদকের বিষয়টি নিয়ে অফিশিয়ালি মেহেদী হাসান কী জবাব দিয়েছেন, সেটা এখনো আমি জানি না। শরীয়তপুরের অফিসে আমি সপ্তাহে দুই দিন যাই। শরীয়তপুর অফিসকে আমি পুরোপুরিভাবে দালাল মুক্ত করেছি। আমার অনুপস্থিতিতে অফিসে কোনো দালাল ঢোকেন কিনা সেটা আমার জানা নেই। আমার অনুপস্থিতিতে মোটরযান পরিদর্শক মেহেদী হাসান দায়িত্বে থাকেন। তারই বিষয়টি দেখভাল করা উচিত। এখন তিনি যদি দায়িত্বে থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন, তাহলে আমার কিছু করার নেই।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) শরীয়তপুরের সভাপতি রাশিদুল হাসান মাসুম ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক কর্মীসহ সকলেরই সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। শরীয়তপুরে বিআরটিএ অফিসে দালালের মাধ্যমে ঘুষ লেনদেনের বিষয়টি নতুন কিছু নয়। ঘুষ লেনদেনের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে দুদক ও সরকার আরও কঠোর হলে সাধারণ মানুষ ভালোভাবে সেবা পাবে। 

বিষয়টি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের মাদারীপুরের উপ-পরিচালক আতিকুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এর আগে অভিযানের সময় শরীয়তপুরের মোটরযান পরিদর্শক মেহেদী হাসানের সঙ্গে দালালের সম্পৃক্ততা পেয়ে তাকে সতর্ক করা হয়েছিল। দালালের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে মেহেদী হাসানকে অন্যত্র বদলির সুপারিশ করেছিল দুদক। কিন্তু এরপরও যদি তার বিরুদ্ধে দালাল সম্পৃক্ততার অভিযোগ পাওয়া যায়, তাহলে আবারও অভিযান পরিচালনা করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সাইফ রুদাদ/আরএআর