কুড়িগ্রামে চরবাসীর স্বেচ্ছাশ্রমে চলছে দেড় কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার বল্লভেরখাষ ইউনিয়নের বেশির ভাগ গ্রামের মানুষকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয়। অসময়ের বন্যা আর বৃষ্টির পানিতে বছরের বড় একটি সময় এখানকার জনপদগুলো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
এ ইউনিয়নের একটি এলাকা চর কৃষ্ণপুর। এই চরের বাসিন্দাদের শিক্ষা-চিকিৎসা-ব্যবসাসহ যেকোনো প্রয়োজনেই উপজেলা শহরসহ আশপাশের বাজারে হেঁটে যাতায়াত করতে শুকনো মৌসুমেও পড়তে হয় চরম দুর্ভোগে। এ ছাড়া অসময়ের বন্যা আর বৃষ্টিতে পায়ে হাঁটার সেই রাস্তাটুকুও তলিয়ে যায় পানিতে। ফলে উঁচু একটি সড়কের অভাবে জীবন-জীবিকার গতি থমকে যায় এই এলাকার মানুষের। বহু বছর অপেক্ষার পরও যখন এখানে একটি সড়ক নির্মাণের দাবি পূরণ হয়নি তাদের, তখন স্থানীয়রা নিজেরাই উদ্যোগ নেন সড়কটি তৈরির।
বিজ্ঞাপন
চর কৃষ্ণপুর গ্রামের বাসিন্দারা জানান, এরকম দীর্ঘ একটি রাস্তা তৈরি করতে তাদের বহু টাকা লাগবে। তারপরও তারা নেমে পড়েছেন নিজেদের যতটুকু সামর্থ্য আছে তা নিয়ে। মনোবল আর শ্রমকে পুঁজি করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইতোমধ্যে গ্রামবাসী শুরু করে দিয়েছেন দেড় কিলোমিটার রাস্তার এ কাজ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রামবাসী উদ্যোগ নিয়ে ইতোমধ্যে নিজেদের শ্রম আর অর্থে রাস্তাটির কাজ শুরু করেছেন। তৈরি করা হয়েছে স্থানীয়দের নিয়ে সড়ক নির্মাণ কমিটি। এই কমিটি আস্থার সঙ্গে দেখভাল করছে কাজটি। কমিটির সদস্যদের মাঝে বিভিন্ন স্তরে কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। সদস্যের কেউ টাকা তুলছেন, আবার কেউ খরচের হিসাব রাখছেন। সড়কটি তৈরি হলে বহুমুখী সুবিধা পাবেন বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
আরও পড়ুন
স্থানীয় আব্দুল মান্নান ঢাকা পোস্টকে জানান, দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকার প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছেন। এই গ্রামে যাতায়াতে কোনো প্রকার রাস্তা নেই। বছরের বেশির ভাগ সময় তাদের বন্যা আর বৃষ্টিতে কষ্ট করতে হয়। সে সময় যাতায়াতের কোনো প্রকার ব্যবস্থা থাকে না। এ ছাড়া শুকনো মৌসুমেও জমির আইল ধরে প্রায় দেড় কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পাকাসড়কে উঠতে হয়। এ পথে উৎপাদিত কৃষিপণ্য কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনা-নেওয়া বড়ই কষ্টের। এ চরের ছেলে-মেয়েরা যোগাযোগের অভাবে লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়েছে। বহু বছর স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং উপর মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করেও একটি সড়ক নির্মাণের ব্যবস্থা হয়নি এখানে। তাই গ্রামবাসী একত্রিত হয়ে নিজেদের সড়ক নিজেরাই তৈরি করছেন।
চরের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউসুব আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, সড়কটি তৈরির জন্য বহুজনের কাছে গিয়েছি, সবাই কথা দিয়েছেন কিন্তু কাজ করেননি কেউ। তাই আমরা নিজেরা উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা জানি একটা সড়কের জন্য আমাদের কত কষ্ট করতে হয়। বন্যা এবং বৃষ্টির মৌসুমে আমাদের ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যেতে পারে না। প্রসূতি মায়ের জরুরি চিকিৎসা করাতে পারি না। সড়কটি নির্মাণ হলে সব সমস্যার সমাধান হবে। এ ছাড়া সড়কটি বন্যার সময় বাঁধের কাজ করবে। ফসলহানি রোধ হবে।
খোকন মিয়া নামের একজন বলেন, সড়কটি নির্মাণে গ্রামবাসীদের একত্রিত করতে আমরা সক্ষম হয়েছি। সবাই সাধ্যমতো টাকা দিয়ে সহযোগিতা করছেন। কেউ শ্রম দিচ্ছেন। সড়ক নির্মাণে একটা কমিটি করেছি। এই কমিটি আস্থার সঙ্গে সড়ক নির্মাণ বাস্তবায়ন করছে।
কমিটির কোষাধ্যক্ষ আব্দুল খালেক জানান, গ্রামের বাসিন্দারা নিম্নে দুই হাজার, কেউ চার হাজার আবার কেউ দশ-বিশ হাজার টাকা পর্যন্ত দিয়েছেন। তবে এই টাকা খুবই কম। সড়কটি নির্মাণে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা খরচ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বল্লভেরখাষ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এস.এম আব্দুর রাজ্জাক বলেন, প্রায় দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি তৈরিতে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষে বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব নয়। তাই চরের বাসিন্দাদের জোটবদ্ধ হয়ে কাজটি শুরু করার পরামর্শ দিয়েছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছি।
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরিফ ঢাকা পোস্টকে বলেন, চর কৃষ্ণপুরবাসী সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিয়ে একটি সড়ক নির্মাণ করছেন, এটি প্রশংসনীয় কাজ। আমরা তাদের কাজে সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। পরিদর্শন করে সেখানে সহযোগিতা প্রদান করা হবে।
মো. জুয়েল রানা/এমজেইউ