মধু সংগ্রহের মৌসুম এলেই সুন্দরবনে প্রবেশের অনুমতিপত্র (পাস-পারমিট) পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন মৌয়ালরা। তবে দৌঁড়ঝাপ না করেও অনুমতিপত্র পাওয়া যায়। এজন্য দালাল ধরতে হয়। তারাই সংগ্রহ করে দেন অনুমতিপত্র। সাতক্ষীরা উপকূলীয় বনজীবীদের কাছে এটি এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। তবে অনুমতিপত্র পাওয়ার জন্য দালালদের দিতে হয় টাকা আর বন বিভাগের কর্মকর্তারা নেন সুন্দরবনের খাঁটি মধু।

সাতক্ষীরার উপকূলীয় মানুষের দুঃখ-কষ্ট, জীবনযাত্রা, জীববৈচিত্র্য এবং নানা বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন ঢাকা পোস্টের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি আকরামুল ইসলাম। ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব আজ।

উপকূলীয় বনজীবীদের অভিযোগ, বন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আগে থেকেই চুক্তি করে রাখেন দালালরা। এজন্য মৌয়ালদের গুনতে হয় বাড়তি টাকা। টাকার পাশাপাশি সুন্দরবনের খাঁটি মধুও দিতে হয় ঘুষ হিসেবে। জনপ্রতি ৫০০ গ্রাম মধু না দিলে মৌয়ালদের পাস ফেরত নেন না বন কর্মকর্তারা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী, কদমতলা, মুন্সিগঞ্জ ও কোবাদক বন স্টেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দালালদের সম্পর্ক রয়েছে। দালালদের মাধ্যমেই মৌয়ালদের পাস দেন বন কর্মকর্তারা।

সাতক্ষীরা রেঞ্জের বুড়িগোয়ালিনী ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, এ স্টেশন থেকে মধু সংগ্রহের জন্য এপ্রিল মাসে ১৪৮টি বিএলসি (বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট) দেওয়া হয়েছে। এসব বিএলসি নিয়ে মধু সংগ্রহের জন্য সুন্দরবনে গেছেন এক হাজার ৭৬ জন মৌয়াল। মধু সংগ্রহ হয়েছে ৫৩৮ কুইন্টাল। যার মূল্য চার লাখ তিন হাজার ৫০০ টাকা। মোম সংগ্রহ হয়েছে ১৬১ কুইন্টাল। যার মূল্য এক লাখ ৬১ হাজার ৪০০ টাকা।

বুড়িগোয়ালিনী ফরেস্ট স্টেশন

সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জ কার্যালয় সূত্র জানায়, বুড়িগোয়ালিনী, কদমতলা, মুন্সিগঞ্জ ও কোবাদক- এই চার স্টেশন থেকে ২৭০টি বিএলসি নিয়ে মধু সংগ্রহের জন্য সুন্দরবনে গেছেন এক হাজার ৪০০ মৌয়াল। ১ এপ্রিল থেকে এ কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। ১৪ দিনের অনুমতিপত্রে একজন মৌয়ালকে ৫০ কেজি মধু সংগ্রহের পাস দেওয়া হয়।

সুন্দরবনঘেঁষা সাতক্ষীরার গাবুরা ইউনিয়নের অধিকাংশ বাসিন্দা উপকূলীয় নদী ও সুন্দরবনের  জীবিকার ওপর নির্ভরশীল। 

গাবুরা ইউনিয়নের সোরা গ্রামের মৌয়াল মিজানুর রহমান বলেন, সুন্দরবনে প্রবেশের জন্য পাস নিতে প্রতি মৌয়ালকে দিতে হয় ৭০০ টাকা। বিএলসির জন্য দিতে হয় এক হাজার ৫০০ টাকা। সুন্দরবন থেকে ফিরে পাস জমা দিতে গেলে বন অফিসে জনপ্রতি ৫০০ গ্রাম করে মধু দিতে হয়। মধু না দিলে পাস জমা নেন না বন কর্মকর্তারা। এটা শুধু আমার বেলায় নয়; সব মৌয়ালকেই দিতে হয়। আমরা বুড়িগোয়ালিনী ফরেস্ট স্টেশনের কর্মকর্তাকে মধু দিই।

তিনি বলেন, কোনো মৌয়াল পাস চাইলে দেয় না বন বিভাগ। শুধু হয়রানি করে। কিন্তু দালাল নিয়ে গেলে ঠিকই পাস দেয়। আমাদের গ্রামের দালাল রেজাউল ইসলাম বন বিভাগের লোকজনের সঙ্গে চুক্তি করে পাস পাইয়ে দেন। এজন্য আমরা তাকে টাকা দিই।

সোরা গ্রামের মৌয়াল শামসের গাজী বলেন, টাকা ও মধুর বিনিময়ে পাস নিয়ে বনে গিয়েও জীবনের নিরাপত্তা নেই। বনে গেলে ফিরতে পারব কি না জানা নেই। এখন বাঘের আক্রমণ বেড়েছে। এ বছর বৃষ্টি কম হওয়ায় সুন্দরবনে মধু কমে গেছে। ফুলে মধু নেই। আমি এ বছর সুন্দরবনে গিয়ে এক ড্রাম মধু পেয়েছি। অন্য সময় ২-৩ ড্রাম মধু পেতাম। রোজগার কমে গেছে।

একই গ্রামের মৌয়াল আসাদুল ইসলাম ও মাহবুর রহমান জানান, সুন্দরবনে যাওয়ার পাস নিতে গেলে সবাইকে দালাল ধরতে হয়। টাকা ও মধু দিতে হয়। বন বিভাগের সব অফিসে একই অবস্থা। বনজীবীদের দুঃখ দেখার কেউ নেই।

গাবুরা ইউনিয়নের চাঁদনিমুখা গ্রামের বনজীবী শহিদুল ইসলাম বলেন, দালালদের ঘুষ দিয়ে মধু সংগ্রহের জন্য সুন্দরবনের ভেতরে প্রবেশের পর সুন্দরবনে দায়িত্বরত টহল টিম ২০০-৫০০ টাকা নেয় জনপ্রতি। আমরা যদি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যাই, তখন এই টাকা দিতে হয়। যে জায়গার পাস নেওয়া সেই জায়গায় থাকলে বাড়তি টাকা নেয় না।

মৌয়ালদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রেজাউল ইসলাম বলেন, আমি এখন বুড়িগোয়ালিনী ফরেস্ট অফিসে আছি। এ ব্যাপারে পরে কথা বলব- বলেই ফোনের সংযোগ কেটে দেন। পরে একাধিকবার ফোন দিলেও ধরেননি তিনি।

সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করছেন মৌয়াল

সাতক্ষীরা রেঞ্জের বুড়িগোয়ালিনী ফরেস্ট স্টেশনের কর্মকর্তা সুলতান আহম্মেদ বলেন, বন কার্যালয় থেকে শুধুমাত্র সরকারি রাজস্ব ৬১০ টাকা নেওয়া হয়। জনপ্রতি ৭০০ টাকা নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। তাছাড়া নৌকাপ্রতি ১৫০০ টাকা নেওয়ার বিষয়টি সঠিক নয়। তবে দালালরা ওই টাকা খেয়েছে কি না সেটি আমার জানা নেই। 

তিনি বলেন, জনপ্রতি ৫০০ গ্রাম মধু নেওয়ার কথা সঠিক নয়। একজন মৌয়ালও বলতে পারবে না। তবে বন বিভাগের কোনো স্টাফ হয়তো নৌকাপ্রতি ৫০০ কিংবা ২৫০ গ্রাম মধু খাওয়ার জন্য চাইতে পারেন। কিন্তু জনপ্রতি ৫০০ গ্রাম মধু নেওয়া হয় না।

অথচ সরেজমিনে দেখা যায়, বন কর্মকর্তা সুলতান আহম্মেদের কার্যালয়ের চারটি ড্রামে অনেক মধু রয়েছে। কার্যালয়ে মধু রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে সুলতান আহম্মেদ বলেন, এসব মধু আমাদের একজন স্টাফ বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য কিনে রেখেছেন।

এএম