প্রতিকূলতা ছাপিয়ে রাজেদারা লড়াই করে বাঁচতে শেখায়
২২ বছর আগে গর্ভে ছয়মাসের সন্তান রেখে স্বামী শাহিন হোসেন দ্বিতীয় বিয়ে করেন। শুরু করেন নতুন সংসার। তখন পৃথিবীতে না আসা সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে অনেকটা নিরুপায় হয়ে রাজমিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন রাজেদা বেগম (৫০)।
২৫ টাকা দিনে কাজ করা রাজেদা এখন প্রধান রাজমিস্ত্রি হিসেবে ৫০০ টাকা দিন হাজিরাতে কাজ করছেন। রাজেদার নেতৃত্বে কমপক্ষে ১০ জন পুরুষ সহযোগী গুরুদাসপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় কাজ করেন।
বিজ্ঞাপন
রাজেদা বেগম নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার মশিন্দা ইউনিয়নের মশিন্দা কান্দিপাড়া গ্রামের মৃত বেল্লাল সরদারের মেয়ে।
রাজেদা জানান, সেইসময় তাদের কোনো জমিজমা ছিল না। অনেক কষ্ট করে টাকা জমিয়ে একই এলাকার শাহিন হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তার। বিয়ের পরেই চাহিদা মতো যৌতুকের টাকা দিতে না পারায় সংসারে ঝামেলা লেগেই থাকত।
রাজেদা বেগম বলেন, বিয়ের দেড় বছরের মাথায় আমার পেটে সন্তান আসে। এমন সময় আমার স্বামী আমাকে ছেড়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। অনেক চেষ্টা করেও তাকে (স্বামীকে) সংসারে ফেরাতে পারিনি। এদিকে বাবা মারা যাওয়ার পর দুই ভাই আলাদা হয়ে যায়। মা আমার সঙ্গে থাকত। অনেকটা নিরুপায় হয়েই রাজমিস্ত্রির যোগালদারের কাজটি বেছে নিয়েছিলাম।
রাজেদা বলেন, অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ আর বৃদ্ধ মায়ের মুখে খাবার তুলে দিতে লোকলজ্জার ভয় উপেক্ষা করে রাজমিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করেছিলাম। প্রথমে ২৫ টাকা দিন পেতাম। রাজমিস্ত্রির সহযোগী হয়ে কাজ শুরু করার চার মাসের মাথায় আমার মেয়ে সন্তান হয়। নাম রাখি শ্যামলী খাতুন।
রাজেদা আরও বলেন, বাচ্চা হওয়ার পরের কয়েক মাস কাজে যেতাম না। এরপর থেকে ৩ মাসের মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে কাজে যাই। মেয়ে নিচে খেলনা নিয়ে খেলা করত আর আমি অন্য শ্রমিকদের সঙ্গে যোগালদারের কাজ করতাম। সেসময় অন্য সহযোগীরা আমাকে সাহায্য করত।
তিনি বলেন, গত চার বছর ধরে হেড রাজমিস্ত্রি হিসেবে কাজ করি। উপার্জিত টাকা দিয়ে মেয়ে শ্যামলীকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়িয়ে বিয়ে দিয়েছি। মেয়ের সুখের সংসার। মাকে নিয়ে এখন ভালোই কাটছে দিন।
মেয়ে হয়ে রাজ মিস্ত্রির কাজ করতে গিয়ে কোনো সমস্যায় পড়তে হয়েছিল কি না জানতে চাইলে রাজেদা বলেন, শুরুতে পুরুষদের সঙ্গে কাজ শুরু করায় অনেকেই বাঁকা চোখে দেখত এবং অনেকে অনেক কথা ই বলত । কিন্তু সব সহ্য করে পরিশ্রম করে টিকে থাকায় পরবর্তীতে আর কেউ বাঁকা চোখে দেখত না। এখন সবাই সম্মান দিয়েই কথা বলে।
গুরুদাসপুর উপজেলা নির্মাণ শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি জয়েন উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাজমিস্ত্রীরা গ্রুপ হয়ে ভবন নির্মাণ করে থাকে। সেই গ্রুপের প্রধানকে বলা হয় হেড মিস্ত্রি। সচরাচর নারী হেড মিস্ত্রি হয় এমনটা খুব কম ই রয়েছে। সেই দিক থেকে হেড মিস্ত্রি রাজেদা ব্যতিক্রম বলা যায়। তার কর্মদক্ষতা দিয়ে তিনি ধীরে ধীরে তার সুনাম অর্জন করেছেন।
এ বিষয়ে স্থানীয় একটি কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রভাষক মো. মাজেম আলী বলেন, সকল প্রতিকূলতা ছাপিয়ে রাজেদারা লড়াই করে বাঁচতে শেখায়। রাজমিস্ত্রি রাজেদা বেগম এই সমাজের অবহেলিত নারীদের জন্য নতুন করে কিছু করার সাহসের প্রতীক হয়ে থাকবে।
গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সালমা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাজেদা বেগমের সাহসিকতার প্রশংসা করতে হয়। কেননা নারীরা সচরাচর সাহস করে ভিন্ন এরকম পেশা বেছে নেন না। তার সাহসী সিদ্ধান্ত, সততা এবং পরিশ্রম তাকে আজকের জায়গায় এনেছে।
সালমা আক্তার বলেন, রাজেদা বেগমের যেকোনো প্রয়োজনে উপজেলা প্রশাসন তার পাশে থাকবে। তিনি যদি মনে করেন কাজের মান উন্নয়নে প্রশিক্ষণ দরকার, আমাদের সঙ্গে আলোচনা করলে সেই ব্যবস্থাও করে দেব।
গোলাম রাব্বানী/এএএ