যেভাবে রক্ষা পেয়েছিল ৭ই মার্চের ভাষণের ভিডিও
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বাঙালীদের একটি স্মরণীয় দিন। সেদিন পরাধীনতার শিকল ভেঙে মুক্তির চেতনায় বাঙালীদের বুকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল। সেই ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠে ভাষণ শুনতে পাকিস্তানি পূর্বাঞ্চলীয় সাময়িক সদর দপ্তরের সবগুলো কামান, ট্যাংক মেশিনগানের নল উপেক্ষা করেও তৎকালীন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জড়ো হয়েছিল লাখো মানুষ।
সেই দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের ১৮ মিনিটের ভাষণ ধারণ করেছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অধীনে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর। সেই সময় তৎকালীন চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের সহকারী ক্যামেরাম্যান ছিলেন আমজাদ আলী খন্দকার। তিনি বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সময় সামনে থেকে ক্যামেরা পরিচালনা করেছিলেন এবং নিজের জীবনের শঙ্কা নিয়েও ধারণ করেছিলেন ৭ই মার্চের সেই কালজয়ী ভাষণের ফিল্ম।
বিজ্ঞাপন
সাভার পৌর এলাকার গেন্ডা মহল্লার খন্দকার ভিলায় বসে সেই অগ্নিঝড়া দিনগুলোর কথা বর্ণনা করেন আমজাদ আলী খন্দকার।
তিনি বলেন, হঠাৎ করেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অধীনে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের ভাষণের সম্পূর্ণ ভিডিও ধারণের সিদ্ধান্ত নেয়। এরই পরিকল্পনায় তাৎকালীন চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের প্রধান মহিবুর রহমান আমাদের নির্দেশ দেন। সেই দিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ধারণের জন্য ৬ জনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর মধ্যে আমাকে ও মবিন সাহেবকে দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধুর যে ক্যামেরায় ভাষণ দেবেন তার দায়িত্ব। আর রউফ সাহেব ও তৌহিদকে ঘুরে ঘুরে শর্ট নিতে বলা হয়। আর দুইজন সহকারী ছিলেন আমাদের সঙ্গে।
আমজাদ আলী খন্দকার আরও বলেন, ৭ই মার্চ সকালে যখন আমরা ক্যামেরা বসাতে মাঠে যাই। তখন দেখি মাঠে লাখো মানুষ জড়ো হয়েছে। মাঠ কানায় কানায় পরিপূর্ণ। এরপরে বঙ্গবন্ধু এসে ভাষণ দিলেন। সেটি আমরা রেকর্ড করে নিয়ে আসি। পরে পরিচালক সাহেব আমাকে দায়িত্ব দিলেন ফিল্ম ডেভলপ করার জন্য। সে সময় বঙ্গবন্ধুর নাম দিলে ফিল্ম নষ্ট করে ফেলতে পারে। তাই এফডিসি ল্যাবে সাইক্লোন ও নির্বাচন নামে ফিল্ম ডেভলপ করে নিয়ে এসে পরিচালককে দেই। তিনি আলমারিতে রেখে দিলেন। পরে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানিরা নিরপরাধ বাঙালিদের ওপর হামলা করে। এ সময় বিভিন্ন অফিস আদালতে হামলা করতে শুরু করে পাকিস্তানিরা। ওই দৃশ্য দেখে পরিচালক মহিবুর রহমান বঙ্গবন্ধুর ভাষণের রেকর্ড রক্ষার উদ্যোগ নেন। তখন আমাকে একটি ট্যাংক কিনে আনতে বলেন। তখন আমি সদরঘাট থেকে ৪২ ইঞ্চি একটি কালো ট্যাংক কিনে এনেছিলাম। ওইটার ভেতরে ৭ই মার্চে ভাষণটি রাখা হয়। এরপরে পরিচালক মহিবুর রহমান ট্যাঙ্কটি নিয়ে দোহারে মজিদ দারগার বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে বলেন। এ সময় আমি আমার বাবার সঙ্গে দেখা করে এসে পরিচালক মহিবুর রহমানের অফিসে আসি। এরপর তিনি আমাকে বিদায় দেওয়ার সময় তার চোখ বড় বড় করে আমার হাতে ঝাঁকি দিয়ে বলছিলেন, ‘আমজাদ আল্লাহ হাফেজ’। কারণ তিনি জানতেন আমি ঢাকা থেকে না বের হতে পারলে আমার জীবনটা আজকেই শেষ।
পরে সার্জেন্ট ফরিদের মাধ্যমে সচিবালয় থেকে বের হলাম। অনেক কষ্ট করে মজিদ দারগার বাড়িতে পৌঁছাই। হঠাৎ জয়পাড়া থানায় পাকিস্তানি হানা দেয়। সেসময় তিনি (মজিদ) আমাকে বললেন, ওমেশ খাঁ-ধানেশ খাঁ বাড়িতে ধানের গোলায় ওই ট্যাংকটি লুকিয়ে রাখার জন্য। পরে ওই বাড়ির ধানের গোলায় বঙ্গবন্ধুর ভার্ষণের রেকর্ডটি রাখা হয়। হঠাৎ মজিদ দারগা যুদ্ধ চলাকালীন কলকাতায় চলে যান। এ সময় তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের মাধ্যমে যুদ্ধ চলাকালীন ধানের গোলা থেকে ওই ট্যাংক কলকাতায় নিয়ে আসে। সেখানেই ৯ মাস ছিল ওই ট্যাংকটি। পরে যুদ্ধ শেষে আবার ফিরিয়ে আনা হয়। এভাবেই রক্ষা যায় বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের রেকর্ড।
তবে আমজাদ আলী খন্দকার বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রক্ষা করতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করেন। তিনি ২০২২ সালে একুশে পদক এ ভূষিত হন। এখন আর জীবনে নতুন করে কিছু চাওয়ার নেই বলে জানান সেই সংগ্রামী ও নিজের জীবনবাজি রাখা আমজাদ আলী খন্দকার ।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। কালজয়ী ওই ভাষণ ১৮ মিনিট স্থায়ী হয়।
এই ভাষণে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) বাঙালিদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবরে ইউনেস্কো ৭ই মার্চের ভাষণকে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
আরকে