সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার কাদিপুর গ্রামে অবস্থিত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান ফটক থেকে ভেতরে প্রবেশ করার পর রাস্তার দুইপাশে চোখে পড়বে গরু-ছাগল চরানোর দৃশ্য। আরেকটু সামনে এগিয়ে গেলে হাতের বাম পাশের ভবনের সামনে নারী, পুরুষ ও শিশুদের লম্বা লাইন। মূলত সেবা গ্রহণের জন্য টিকিট কাউন্টারকে ঘিরে তাদের এ লাইন। এ টিকিট কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা কেউ ব্যস্ত মোবাইলে, কেউ গল্প গুজবে আর কেউবা মাঝেমধ্যে টিকিট কেটে দিচ্ছেন লাইনে দাঁড়ানো সেবা প্রত্যাশীদের। বলছিলাম সিলেট জেলার বিশ্বনাথ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কথা।

সরেজমিনে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ঘুরে নানা অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার চিত্র তুলে আনেন ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদক।

টিকিট কাউন্টারের ভেতরে সচরাচর আনাগোনা থাকে বহিরাগতের। স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার জন্য টিকিট প্রত্যাশীরা লাইনে দাঁড়ানো থাকলেও টিকিট কাউন্টারের ভেতরে থাকা দায়িত্বরতদের মোবাইলে কথা বলা, ইন্টারনেট ব্রাউজিং ও গেইমস খেলার চিত্র যেন নিত্যদিনের ঘটনা। লাইনে দাঁড়ানো কেউ কেউ এর প্রতিবাদ করলে সার্ভার ডাউনের অযুহাতে তাদেরকে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখেন।

মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংরক্ষিত কেবিনে স্বাস্থ্য কর্মকর্তার প্রাইভেট রোগী ভর্তি থাকেন। 

আউটডোরে ডাক্তার দেখানোর টিকিট কাটলে পুরুষদের দেওয়া হয় ১০১ নম্বর কক্ষে আর মহিলাদের দেওয়া হয় ১০২ নম্বর কক্ষে। কিন্তু জনবল সংকটের অযুহাত ও ডাক্তারদের অনুপস্থিতির জন্য বন্ধ থাকে ১০২ নম্বর কক্ষটি। ফলে বাধ্য হয়েই পুরুষদের পাশাপাশি মহিলারাও সেবা নেন ১০১ নম্বর কাউন্টার থেকেই।

হাসপাতাল ভবনে প্রবেশের পর একটি হেল্প ডেস্ক থাকলেও সেটি পড়ে আছে ময়লা ও ভুতুড়ে পরিবেশে। জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসক না থাকলেও বেশিরভাগ সময়ে চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকেন ওয়ার্ড বয় হিসেবে কর্মরত সৌরভ। ইনজেকশন পুশ করা থেকে শুরু করে ব্যান্ডেজ দেওয়া সবকিছুই একাই সামলে নেন তিনি। আর সেখানে কর্মরত নার্স ব্যস্ত থাকেন কম্পিউটার অপারেটিংয়ের কাজে। এমনকি বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেনটেটিভ কমপ্লেক্স ভবনের ভেতরেই রোগীদের ব্যবস্থাপত্রের ছবি, ভিডিও ধারণ করেন।

রোগ নির্ণয়ের জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন কক্ষের দরজা প্রায়ই থাকে তালা বদ্ধ। ইসিজির জন্য আলাদা কক্ষ থাকলেও তা কর হয় জরুরি বিভাগ থেকে। নারীদের জন্য মহিলা নার্স দিয়ে পর্দার আড়ালে ইসিজি করা হলেও ইসিজি করার বেডের ঠিক ওপরে সচল রয়েছে সিসি ক্যামেরা। যেটি দেখা যায় উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কক্ষের বড় মনিটর থেকে।

বেশ কয়েকদিন পুরো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ছদ্মবেশে ঘুরলেও আবাসিক মেডিকেল অফিসারের নাগাল পাওয়া তো দূরের কথা তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি হাসপাতালের আশপাশে।

বিভিন্ন ওয়ার্ড, কেবিনে ভর্তি রোগী ও তাদের স্বজনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তাদের বিস্তর অভিযোগ। তবে সেবা ব্যাহত হওয়ার ভয়ে তারা ন্যূনতম প্রতিবাদ করার সাহসটুকুও পান না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রোগীর এক স্বজন বলেন, ভাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সম্পর্কে জানতে আপনাকে বেশি কষ্ট করতে হবে না। আপনি ওয়াশরুমগুলো একবার ঘুরে আসেন। বেসিন আর কমোডের অবস্থা একবার দেখেন। এইগুলা কি আমাদের পরিষ্কার করার কথা। আমরা এখানে এসে বিপদে আছি। মুক্তিযোদ্ধাদের নামে সংরক্ষিত একটি কেবিন আছে হাসপাতালে। আপনি গিয়ে দেখেন সেখানে যিনি চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি কি মুক্তিযোদ্ধা? বা তার স্বজনের কেউ? তিনি অভিযোগ করেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তার প্রাইভেট রোগী হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও ভালো সেবা নিচ্ছেন কেবিনে ভর্তিরত ব্যক্তি।

সরেজমিনে মুক্তিযোদ্ধার জন্য সংরক্ষিত কেবিনে গিয়ে তার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। সেখানে ভর্তিরত রোগীর নাম আব্দুল বাছিত। তারা বাড়ি পার্শ্ববর্তী ওসমানীনগর উপজেলায়। আব্দুল বাছিতের স্বজন কামরুল হাসান এ প্রতিবেদককে বলেন, আমরা ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। পরে এখানকার স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে এখানে ভর্তি হই। তিনিই আমাদেরকে এই কেবিনে দিয়েছেন। তবে আমরা মুক্তিযোদ্ধা নই।

বিভিন্ন অনিয়ম, অবহেলা ও অভিযোগ নিয়ে কথা হয় বিশ্বনাথ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার দেলোয়ার হোসেন (সুমন) এর সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, টিকিট কাউন্টারে বহিরাগতের বিষয়ে আমি জানি না। তবে এমন ঘটনা ঘটে থাকলে এখনই ব্যবস্থা নেব।

আউটডোরে পুরুষদের ১০১ নম্বর কক্ষে নারীদের চিকিৎসা দেওয়া হয় কিন্তু টিকিটে দেওয়া থাকে ১০২ নম্বর কক্ষ এটি কেন হয়? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, টিকিট সার্ভারে মহিলাদের ১০২ নম্বর কক্ষ থাকায় অটোমেশন প্রক্রিয়ায় হওয়ায় এমন টি হচ্ছে। চিকিৎসকের সংকট থাকায় তাদেরকে একসঙ্গে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। অপরিচ্ছন্নতা-অব্যবস্থাপনা ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গরু ছাগল চরানোর বিষয়ে সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জনবল সংকটের অযুহাতে বিষয়টি পাশ কাটিয়ে গেলেও পশু চরানোর বিষয়টি স্বীকার করেন।

ইসিজি করার বেডের ওপরে সিসি ক্যামেরার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি শুধু আমি মনিটরিং করি। আমি ছাড়া অন্য কেউ দেখতে পারেন না। গোপনীয় বিষয়টি আপনি মনিটরিং করতে পারেন কি না এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।

সার্বিক বিষয় নিয়ে সিলেট জেলা সিভিল সার্জন কর্মকর্তা ডাক্তার মনসুর চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি আপনার কাছ থেকে বিষয়গুলো জানলাম। ওয়ার্ড বয়ের ইনজেকশন পুশ করা সম্পর্কে তিনি বলেন, এ কাজ তার করার কথা না। এ জন্য নির্ধারিত লোক রয়েছেন। মহিলাদের ইসিজি বেডের ওপর সিসিটিভি ক্যামেরার বিষয়টি দৃষ্টিকটু। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা হাসপাতাল ভবনে প্রবেশ করে রোগীর ব্যবস্থাপত্রের চিত্র ধারণ করতে পারেন না। এ বিষয়ে অধিদপ্তরের নির্দেশনা আছে। এগুলোর বিরুদ্ধে অচিরেই আমি ব্যবস্থা নেব।

এএএ