পাসপোর্ট অফিসের ভেতরে কম্পিউটার দোকানি রহমত উল্লাহ / ছবি : ঢাকা পোস্ট

নাটোর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে ফের অনিয়ম-দুর্নীতি বাড়তে শুরু করেছে। অফিসটি নতুন ভবনে আসার পর বেশ কিছু দিন অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ থাকলেও নতুন করে দালালদের সক্রিয় সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। পাসপোর্ট অফিসে দালালদের প্রকাশ্যে ঘুরতেও দেখা গেছে। সেবাগ্রহীতাদের অভিযোগ, পাসপোর্ট অফিসের স্টাফদের যোগসাজশে দালালরা তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। 

তবে সচেতন হলে দালাল চক্রের জালে না জড়িয়ে তিন-চার দিন ঘুরে অতিরিক্ত টাকা ছাড়াই পাসপোর্ট পাওয়ার নজিরও রয়েছে এখানে। সেক্ষেত্রে বেশির ভাগ সেবাগ্রহীতা ভোগান্তি এড়াতে দালাল চক্রের শরণাপন্ন হয়ে পাসপোর্ট করে থাকেন। পাসপোর্ট অফিসে দালালির কাজে অফিসের বাহিরে থাকা অধিকাংশ কম্পিউটার দোকানিরাই জড়িত রয়েছেন বলে জানান ভুক্তভোগীরা।

নাটোর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন এই অফিস থেকে ২৫০-৩০০ জন মানুষ সেবা গ্রহণ করে থাকেন। যার মধ্যে গড়ে ১২০-১৫০টি নতুন পাসপোর্টের জন্য আবেদন পড়ে এবং ১২০-১৫০টি তৈরি হওয়া পাসপোর্ট গ্রহণ করতে আসেন সেবাগ্রহীতারা।

অভিযোগ রয়েছে, ভুক্তভোগীদের সামান্য সমস্যায় বেকায়দায় ফেলে অফিসের আনসার সদস্য এবং দালালরা নির্ধারিত অংকের টাকা আদায় করে থাকেন।

সরেজমিনে গিয়ে দালাল সিন্ডিকেটের সঙ্গে অফিসের কয়েকজন আনসার সদস্য এবং অফিসের বাহিরে গড়ে ওঠা কয়েকটি কম্পিউটার ও ফটোস্ট্যাট দোকানির জড়িত থাকার সত্যতা মেলে। দালালদের সঙ্গে পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশ রয়েছে বলেও অভিযোগ করেন সেবাগ্রহীতারা।

সরেজমিনে গত বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে নাটোর সদর উপজেলার হড়িশপুর পুলিশ লাইন্স এলাকায় অবস্থিত নাটোর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে দেখা যায়, দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে অফিসে দুপুরের খাবার বিরতির সময়ে অফিসের সকল কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ। অফিসটির ১০৩ নম্বর কক্ষের দরজাও বন্ধ ছিল। তবে দরজা বন্ধ থাকলেও বাইরে দুই ব্যক্তি দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ দরজা খুলে এক আনসার সদস্য দাঁড়িয়ে থাকা দুই ব্যক্তির মধ্যে থেকে একজনকে ভেতরে প্রবেশ করান। ওই ব্যক্তির হাতে ছিল একটি পাসপোর্ট সংক্রান্ত কাগজ। যা দেখলে যে কেউ মনে করবেন ওই ব্যক্তি পাসপোর্ট করাতে এসেছেন। পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভেতরে প্রবেশ করা ওই ব্যক্তি কোনো সেবাগ্রহীতা নন। তিনি অফিসের বাহিরে থাকা একটি কম্পিউটার ও ফটোস্ট্যাটের দোকানদার রহমত উল্লাহ। তিনি দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা অপর ব্যক্তির জন্য টাকার বিনিময়ে দ্রুত কাজ করাতে এসেছেন।

কথা হয় দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা সেবাগ্রহীতার সঙ্গে। তার নাম মো. জুয়েল রানা। তিনি জেলার লালপুর উপজেলার একটি গ্রাম থেকে এসেছেন। জুয়েল রানা দীর্ঘ ৭ বছর কাতারে ছিলেন। ছুটিতে দেশে আসলে কিছু দিন আগে তার পাসপোর্টটি হারিয়ে যায়। সেই পাসপোর্ট নতুন করে তোলার জন্য পাসপোর্ট অফিসে আসেন তিনি। 

জুয়েল রানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাসপোর্টটি আমার অতি দ্রুত প্রয়োজন। আনারুল নামে আমার এক পরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করলে দ্রুত পাসপোর্ট পাইয়ে দেবে বলে জানায়। যার জন্য বাড়তি কিছু টাকা খরচ করতে হবে।

তিনি বলেন, আনারুল ফোনে মিঠু নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয়। পরবর্তীতে মিঠু আমাকে পাসপোর্ট অফিসের বাহিরে একটি কম্পিউটারের দোকানে ১৫০০ টাকা দিতে বলে। সেই টাকা দিলে কম্পিউটার দোকানি রহমত নিজে পাসপোর্ট অফিসের ভেতরে ঢুকে কাজ করেন। ওই কম্পিউটার দোকানির সঙ্গে আনসারদের যোগসাজশ রয়েছে। 

ঘটনার বেশ খানিকক্ষণ আগে থেকেই কম্পিউটার দোকানি রহমান উল্লাহকে নজরে রাখেন এই প্রতিবেদক। সেখানে দেখা যায়, সেবাগ্রহীতাদের পাসপোর্ট অফিসের ভেতরে প্রবেশের সময় মূল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আনসার সদস্যদের দ্বারা নানা প্রশ্ন-উত্তরের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। অথচ কম্পিউটার দোকানি রহমত উল্লাহ একাধিকবার আসা যাওয়া করলেও তাকে সামান্য জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করেননি আনসার সদস্যরা।

এদিন পাসপোর্ট অফিসে এসে বিড়ম্বনায় পড়া বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। পাসপোর্ট অফিসের সামনের একটি চায়ের দোকানে মন খারাপ করে বসে ছিলেন গুরুদাসপুর উপজেলা থেকে আসা রিজভী হোসেন।

মন খারাপের কারণ জানতে চাইলে রিজভী বলেন, জীবিকার তাগিদে বিদেশ যাব, সেজন্য পাসপোর্ট করতে আসছিলাম। কিন্তু কাগজপত্র কিছু অসম্পূর্ণ রয়েছে বলে আবেদন গ্রহণ করেনি তারা। বাহিরে এসে পাসপোর্ট করতে আসা বেশ কয়েকজনের সঙ্গে আমার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি। তারা আমাকে বলে কিছু বাড়তি টাকা খরচ করলেই সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে‌। তাদের সঙ্গে কথা বলে, পাসপোর্ট অফিসের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা আনসার সদস্যকে গিয়ে বলি আমার কাগজ পত্রের ত্রুটির কথা। সবকিছু শুনে ওই আনসার সদস্য আমাকে বলেন, সবকিছুর সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে, তার জন্য টাকা লাগবে ১৫০০। আমার কাছে ওতো টাকা নেই বললে আনসার সদস্য বলেন, এর নিচে হবে না।

রিজভী বলেন, কাগজপত্রের ত্রুটির জন্য পাসপোর্টের আবেদন হয়নি এজন্য আমার খারাপ লাগছে না। কিন্তু অবৈধভাবে ১৫০০ টাকা দিতে না পারার জন্য আমার পাসপোর্টের আবেদনটি হয়নি এমনটা ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

নাম না প্রকাশের শর্তে বড়াইগ্রাম থেকে আসা এক ভুক্তভোগী বলেন, আমার বোনের পাসপোর্টের আবেদন জমা দিতে গেলে অফিসের ভেতরে থাকা লোকজন কাগজপত্রে ত্রুটি রয়েছে বলে পুনরায় ঠিক করে নিয়ে যেতে বলেন। বাহিরে এসে রয়েল কম্পিউটার নামে দোকানে গেলে দোকানদার বলেন ১৫০০ টাকা দিলে সব হয়ে যাবে। টাকা নিয়ে পাসপোর্ট অফিসের ১০৩ নম্বর রুমে যেতে বলেন কম্পিউটার দোকানদার। সেখানে গেলে ফিরিয়ে দেওয়া সেই একই কাগজ তারা জমা নেন। 

তবে দালাল ধরা ছাড়া কাজ হওয়ার নজিরও রয়েছে অফিসটিতে। সচেতন সেবাগ্রহীতারা দালালদের ছাড়াই তাদের কাজ করে নিচ্ছেন। সামান্য ত্রুটির কারণে অনেক সময় সচেতনদেরও বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।

বড়াইগ্রাম থেকে নিশান আলী বলেন, এই অফিসে দালাল ধরা বা টাকা দেয়া ছাড়া পাসপোর্ট হয় না এমনটি নয়। আমি নিজে দালাল ছাড়া পাসপোর্টের আবেদন করেছি। তবে সামান্য ত্রুটির জন্য আমাকে দুই-তিন দিন ঘুরতে হয়েছে। সে সময় দালাল ধরলে হয়তো এই বিড়ম্বনায় পড়তে হতো না।

সদর উপজেলার আহম্মেদপুর এলাকার রাসেল আহমেদ বলেন, নিজের ও আমার স্ত্রীর পাসপোর্টের জন্য আবেদন করলাম। নিজেরাই সকল কাগজপত্র জমা দিয়েছি, এক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত টাকার বাহিরে অতিরিক্ত কোনো টাকা লাগেনি। তবে শুরুতেই বাহিরে থাকা কম্পিউটার দোকানে গেলে দ্রত সময়ের ভেতর বিড়ম্বনা ছাড়া সব কাজ করে দেওয়ার লোভ দেখান দালালরা।

এদিকে পাসপোর্টের আবেদন ফরমসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাসপোর্ট অফিসে জমা দেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই সাধারণত পুলিশ ভেরিফিকেশন সম্পন্ন করতে হয়। অভিযোগ রয়েছে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা পাসপোর্ট প্রতি ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা নিয়ে থাকেন। আবার টাকা ছাড়াও পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়েছে এমন নজিরও রয়েছে।

সম্প্রতি পাসপোর্ট হাতে পেয়েছেন নাটোর সদর উপজেলার কাফুরিয়া ইউনিয়নের সবুজ হোসেন। সবুজ হোসেন বলেন, আমার পাসপোর্টের পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য আমাকে শহরে ডেকে নেন। সকল কাজ শেষে আমার কাছে খরচ বাবদ ৫০০ টাকা দাবি করেন ওই পুলিশ সদস্য। আমার কাছে একটি ৫০০ টাকার নোট ছিল তাকে সেটা দেই। আমার এই ৫০০ টাকা ছাড়া গাড়ি ভাড়া দেওয়ার মতো টাকা নেই বললে ওই পুলিশ সদস্য ১০০ টাকা ফেরত দেন।

সদর উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের সোহেল রানা বলেন, পাসপোর্টের জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশন আসলে তাদের টাকা-পয়সা দিতে হয় শুনেছি। কিছু দিন আগে আমার পাসপোর্টের ভেরিফিকেশন আসা পুলিশ সদস্য আমার থেকে টাকা চায়নি। আমি নিজ থেকে দিতে গেলেও তিনি টাকা নেননি। উল্টো আমাকে চা খাওয়ান ওই পুলিশ সদস্য।

এসব বিষয়ে নিয়ে জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিটি সরকারি দপ্তরেই আমরা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা চাই। যাতে সাধারণ মানুষ বিড়ম্বনা ছাড়া তাদের কাজ করতে পারে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে আমরা শুনে আসছি পাসপোর্ট অফিসের স্টাফরা কৌশল করে সেবাগ্রহীতাদের থেকে দালালদের মাধ্যমে বাড়তি উৎকোচ আদায় করেন। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া দরকার।

তিনি বলেন, পরিত্রাণ পেতে সবার আগে প্রয়োজন সেবাগ্রহীতাদের সচেতন হওয়া। তারা যদি সচেতন হয় এবং অবৈধ উপায়ে দ্রুত কাজ করার মানসিকতা পরিবর্তন করে তাহলে পাসপোর্ট অফিসের দুর্নীতি কিছুটা হলেও কমে আসবে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে নাটোর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-সহকারী পরিচালক খন্দকার কাজল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিদিন আমাদের অফিসটিতে প্রায় ৩০০ মানুষের আগমন ঘটে। সে অনুযায়ী অফিসে জনবল একদমই কম। ফলে অনেক সময় আনসার সদস্যদেরকে দিয়েও কাজ করাতে হয়। এ ক্ষেত্রে সব সময় তাদের তদারকি করা হয় না।

তিনি বলেন, অফিসের ভেতরে বাহিরের কম্পিউটার দোকানিদের ঢুকতে নিষেধ করা হয়েছিল। অফিস স্টাফদের সহযোগিতায় ভেতরে ঢুকে তারা যদি অবৈধভাবে কর্যক্রম চালায়, আর সেটার যদি প্রমাণ মেলে তাহলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোপূর্বে এক আনসার সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসলে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

পুলিশ ভেরিফিকেশনে গিয়ে সেবাগ্রহীতাদের থেকে টাকা দাবির বিষয়ে জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার (ডিএসবি) পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) কাজী জালাল উদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, জনগণের কল্যাণে ননস্টপ সেবা দিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। কোনো অনৈতিক কার্যকলাপে যুক্ত না থাকার জন্য পাসপোর্টের তথ্য যাচাইয়ে যাওয়া তদন্তকারী কর্মকর্তাকে আমাদের নির্দেশনা দেওয়া আছে। কোনো সদস্যের অর্থনৈতিক লেনদেন করার কথা নয়। যদি কেউ টাকা দাবি করে ভুক্তভোগীরা যাতে আমাদের জানান। 

এ বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. মাছুদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাসপোর্ট অফিসে মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে সেবা গ্রহণ করতে পারে সেজন্য প্রতি মাসে জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় আলোচনা হয়ে থাকে। পাসপোর্ট অফিসের বাহিরে থাকা কম্পিউটার দোকানিদের দালালি বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর একাজে পাসপোর্ট অফিসের স্টাফদের যদি জড়িত থাকার প্রমাণ মেলে তাদের বিরুদ্ধেও বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

পাসপোর্ট অফিস একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এখানে সেবা গ্রহীতাদের থেকে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

আরএআর