ঝাড়ুদার শাজাহান ও দালাল রফিকুলদের দখলে ঠাকুরগাঁও পাসপোর্ট অফিস
ঠাকুরগাঁও আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিনই কমবেশি বিভিন্ন বয়সী মানুষের আনাগোনা থাকে। কেউ আসেন পাসপোর্ট করতে আর কেউবা পাসপোর্ট নেওয়ার জন্য। সেবাপ্রত্যাশীদের অভিযোগ, দালাল ছাড়া পাসপোর্ট করতে গেলে ভোগান্তির যেন শেষ নেই। আর দালাল ধরলেই সব সমস্যার সমাধান।
জানা যায়, ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ইসলামবাগ এলাকার একটি ভাড়া করা ভবনে ঠাকুরগাঁও আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। পরে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে কলেজপাড়া রোডে নিজস্ব অফিসে কার্যক্রম শুরু হয়। ঠাকুরগাঁও আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিন গড়ে ১৫০ থেকে ২০০টি আবেদন জমা পড়ে।
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদক ঠাকুরগাঁও আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে কয়েক দিন আসা-যাওয়া করে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের কেউ কেউ চক্রের মাধ্যমে সহজে পাসপোর্ট হাতে পেয়েছেন। আবার কেউ কেউ অনেক দিন ধরে ঘুরছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, ঠাকুরগাঁও পৌরশহর, ইসলামবাগ ও কলেজ রোডের পাশে সারিবদ্ধ কম্পিউটার ও ফটোকপির দোকানের সাইনবোর্ড। এসব দোকান ঘিরেই তৎপর পাসপোর্ট দালাল চক্রের সদস্যরা।
আরও পড়ুন
এ ছাড়া পাসপোর্ট অফিসের সামনে গেলে দালাল চক্রের কয়েকজন সদস্যকে সেখানে দেখা যায়। তারা সেবাপ্রত্যাশীদের বিভিন্নভাবে ম্যানেজ করে তাদের পরিচিত কম্পিউটারের দোকানে নিয়ে যান। তারা বিভিন্ন অজুহাতে গ্রাম থেকে আসা মানুষদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে দালাল চক্রের সদস্যরা।
এদিকে ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদক ঠাকুরগাঁও জেলা পাসপোর্ট অফিসে গেলে প্রথমেই দেখা হয় অফিসের কর্মচারী শাজাহানের (৫০) সঙ্গে, যিনি ঝাড়ুদার পদে কাজ করছেন। তবে ঝাড়ুদার হলেও তাকে সব সময় গেটের সামনেই অবস্থান করতে দেখা যায়। কেউ পাসপোর্ট করতে গেলেই শাজাহান তার সঙ্গে কথা বলেন।
পরিচয় গোপন রেখে ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদক পাসপোর্ট করার বিষয়ে কথা বলেন ঝাড়ুদার শাজাহানের সঙ্গে। তিনি বলেন, আপনি নিজে সহজে পাসপোর্ট করতে পারবেন না। অফিসের সামনে লিমন কম্পিউটার নামের একটি দোকান আছে। সেখানে গেলে খুব সহজেই আপনার পাসপোর্ট হয়ে যাবে।
ঝাড়ু দেওয়া বাদ দিয়ে গেটে দাঁড়িয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি মানুষের সেবা করছি। যারা বিভিন্ন ধরনের কাগজ নিয়ে সমস্যায় ভুগেন সেই কাগজগুলো আমি সমাধান করে তাদেরকে অফিসে পাঠিয়ে দিই। যাতে তারা খুব সহজে কাজটি করতে পারে।
শাজাহানের দেওয়া তথ্যমতে লিমন কম্পিউটার নামের দোকানে গেলে দেখা হয় রফিকুল নামের এক দালালের সঙ্গে। তিনি বলেন, যদি ১০ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট নিতে চান তাহলে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা খরচ হবে। আপনি শুধু ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে যাবেন। পুলিশ ভেরিফিকেশনসহ সব কাজ আমাদের। আপনি শুধু একদিন এসে পাসপোর্ট নিয়ে যাবেন। আর ১০ দিনের বেশি সময়ে পাসপোর্ট নিতে চাইলে আপনার খরচ হবে ৮ হাজার টাকা।
পরদিন সাংবাদিক পরিচয়ে কথা বলতে গেলে রফিকুল ঢাকা পোস্টকে বলেন, এর সঙ্গে আমি একা জড়িত নয়। পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ অনেকেই জড়িত।
তিনি আরও বলেন, প্রতি পাসপোর্টে তিন হাজার টাকা বেশি নিলেও এর মধ্যে ভেরিফিকেশন বাবদ ১ হাজার ৫০০ টাকার মতো পুলিশকে দিতে হয়। আর বাকি টাকা যায় পাসপোর্ট অফিসে। প্রতি ফাইলে আমি মাত্র ৫০ থেকে ১০০ টাকা পাই।
পাসপোর্ট অফিসের কম্পাউন্ডে সিটিজেন চার্টারে উল্লেখ আছে পাসপোর্টের নিয়মাবলি। টাকার অঙ্কে উল্লেখ করা হয়েছে, অনলাইনে আবেদনের ক্ষেত্রে ৪৮ পৃষ্ঠার এবং পাঁচ বছর মেয়াদসহ নিয়মিত পাসপোর্ট করতে ৪ হাজার ২৫ টাকা (বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আবেদনের ক্ষেত্রে ১৫% ভ্যাটসহ) ফি জমা দিতে হবে। এই পাসপোর্ট পেতে ১৫ থেকে ২১ দিন অপেক্ষা করতে হবে। আর জরুরি পাসপোর্ট করতে লাগবে ৬ হাজার ৩২৫ টাকা। এ জন্য অপেক্ষা করতে হবে ৭ থেকে ১০ দিন। অন্যদিকে ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যে অতীব জরুরি পাসপোর্ট পেতে চাইলে দিতে হবে ৮ হাজার ৫০ টাকা। এ ছাড়া ৪৮ পৃষ্ঠার এবং দশ বছর মেয়াদসহ নিয়মিত পাসপোর্ট করতে ৫ হাজার ৭৫০ টাকা লাগবে। এই পাসপোর্ট পেতে অপেক্ষা করতে হবে ১৫ থেকে ২১ দিন। আর ৭ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে জরুরি পাসপোর্ট পেতে চাইলে ফি দিতে হবে ৮ হাজার ৫০ টাকা। এর বাইরে অতীব জরুরি পাসপোর্ট ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যে নিতে চাইলে শুধু ফি গুনতে হবে ১০ হাজার ৩৫০ টাকা।
সরকারি চাকরিজীবী যাদের এনওসি, অবসর সনদ (পিআরএল) রয়েছে তারা নিয়মিত ফি জমা দেওয়া সাপেক্ষে জরুরি সুবিধা/জরুরি ফি জমা দেওয়া সাপেক্ষে অতীব জরুরি সুবিধা পাবেন। পাসপোর্ট নবায়নের ক্ষেত্রে সমপরিমাণ ব্যাংক চালান প্রযোজ্য।
আরও পড়ুন
আশরাফুল নামের এক সেবাগ্রহীতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি নিজে যখন পাসপোর্ট করতে যাই তখন দিনের পর দিন ঘুরতে হয়েছে। কিন্তু যখন দালাল দিয়ে কাজটি করাই তখন তারা বলে আপনাকে আর ঘুরতে হবে না।
কথা হয় পাসপোর্ট করতে আসা তারা মিয়া নামের আরও একজনের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, কম্পিউটারের দোকানে অনলাইনে আবেদন করতে গেলে তারা বলেন, আমরাই করে দিচ্ছি। আপনি করলে অনেক বেশি সময় লাগবে। সেজন্য আমি কম্পিউটারের দোকানে যে দালাল ছিল তাকে আমার কাগজসহ সবকিছু দিয়েছি। বেশি টাকা লাগছে কিন্তু কাজটা খুব সহজেই হচ্ছে। এর আগে আমি একবার নিজে করার চেষ্টা করেছিলাম। অনেক ঘুরতে হয়েছে। বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। সেজন্য বিরক্ত হয়ে দালালের মাধ্যমে কাজটা করাতে বাধ্য হচ্ছি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঠাকুরগাঁও আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপসহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আলিম উদ্দিন ভূঁঞা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের অফিসের এমন কোনো কর্মকর্তা এসব কাজের সঙ্গে জড়িত নয়। যারা অভিযোগ করছে তা ভিত্তিহীন। তারপরও আমাদের অফিসের কেউ যদি এসব কাজে জড়িত থাকে তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঝাড়ুদার শাজাহানের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, তিনি (শাজাহান) মানুষকে সহযোগিতা করেন।
আরও পড়ুন
পুলিশ ভেরিফিকেশনে টাকা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ঠাকুরগাঁও জেলা পুলিশ সুপার উত্তম প্রসাদ পাঠক ঢাকা পোস্টকে বলেন, হয়ত আগে এরকম ঘটনা ঘটত, কিন্তু আমি আসার পর এমন কোনো ঘটনা ঘটার সুযোগ নেই।
সার্বিক বিষয়ে জানতে ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এমজেইউ