বিয়ের বয়স এক বছর। গর্ভবতী হওয়ার পর কাজের সুবাদে স্বামী চলে যান ঢাকায়। গর্ভে সন্তান থাকা অবস্থায় প্রতিবেশী এক নানা কিনে দিতেন ফলমূল। নিজ খরচে সিজার অপারেশন করান তিনি। তবে জন্ম দিলেও সন্তানের মুখ দেখতে পারেননি মা। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন গর্ভে পাঁচ মাস বয়সে বিক্রি হয়ে যায় তার সন্তান।

ঘটনাটি ঘটেছে বগুড়ার ধুনট উপজেলার বেলকুচী ইউনিয়নের বেলকুচী গ্রামে। গত বছরের ২৮ নভেম্বর শেরপুর উপজেলার মাহবুব ক্লিনিক নামে একটি প্রতিষ্ঠানে ওই সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। পরে সেই ক্লিনিক থেকেই নবজাতককে বিক্রি করে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ তুলেন নবজাতকের মা আয়েশা আক্তার (১৫)। তবে প্রভাবশালী নানাদের হুমকি-ধামকির ভয়ে কাউকে বলতে সাহস পাচ্ছিলেন না।

পরবর্তীতে স্থানীয় এক শিক্ষক ফৌজিয়া বিথীর মাধ্যমে ঘটনাটি জানাজানি হয়। এ ঘটনায় গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ধুনট থানায় মামলা করেন প্রসূতি মা আয়েশা আক্তার।  

পরে সন্তান জন্মের প্রায় আড়াই মাস পর গত ১৭ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ধুনট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ওই শিশুকে অসুস্থ অবস্থায় ভর্তি করে পালিয়ে যায় এক ব্যক্তি। পরে সেদিন বিকেলেই পুলিশ এসে উদ্ধার করে শিশুটিকে। তবে ধরাছোঁয়ার বাইরে আছে অভিযুক্তরা।

ধুনট থানায় করা অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, আয়েশা আক্তার তার নানি আছিয়া খাতুনের সঙ্গে বেলকুচী গ্রামে বসবাস করেন। প্রায় এক বছর আগে সোহেল রানার সঙ্গে আয়েশা আক্তারের বিয়ে হয়। বিয়ের পর আয়েশা গর্ভবতী হলে স্বামী তাকে নানির বাড়িতে রেখে ঢাকায় চলে যান। আয়েশার দরিদ্রতার সুযোগে একই গ্রামের মো. শাহিন (৫৮), আব্দুস সালাম তাকে শেরপুরের মাহবুব ক্লিনিকে নিয়ে যায়। সেখানে সিজারের মাধ্যমে বাচ্চা প্রসব হয়। সেই বাচ্চা ক্লিনিক থেকে বিক্রি করেন অভিযুক্তরা।

এ কাজে আব্দুর রাজ্জাক, সম্রাট মণ্ডলসহ আরও কয়েকজন ছিল। মামলায় তাদেরকেও আসামি করা হয়। ওই সময় ক্লিনিকে থাকাবস্থায় আয়েশা ও তার নানি আছিয়ার কাছে কয়েকটি সাদা কাগজে সাক্ষর নেন অভিযুক্তরা। পরবর্তীতে সন্তানকে দেখতে না পেয়ে জানতে চাইলে আয়েশাকে মেরে ফেলার হুমকি দেন তারা।

গত রোববার দুপুরে বেলকুচি গ্রামে গেলে নবজাতক সন্তানকে কোলে নিয়ে থাকতে দেখা যায় কিশোরী মা আয়েশা আক্তারকে। জানালেন সন্তানের নাম রেখেছেন ইব্রাহিম।

সন্তান বিক্রির মূল হোতা হিসেবে শাহিনকে দায়ী করেন আয়েশা আক্তার। তিনি বলেন, সন্তান পেটে পাঁচ মাস থাকতেই শাহিন নানা প্রায় প্রতিদিন আমার জন্য ফলমূল নিয়ে আসতেন। আমিও তাকে জিজ্ঞেস করছি, নানা আপনি প্রতিদিন এসব কেন নিয়ে আসেন? তিনি কিছু বলতেন না। আমার বাচ্চা যখন নয় মাস গর্ভে, তখন শাহিন নানা একবার ক্লিনিকে নিয়ে গিয়েছিল সিজার করার জন্য। কিন্তু ডাক্তার যখন বলছে এখন সিজার করলে মা ও সন্তান দুজনেরই ক্ষতি হবে, তখন আমাকে নিয়ে চলে আসে। এরপর নভেম্বরে আবার আমাকে নিয়ে যায় শাহিন নানা। আমি যেতে না চাইলে জোর করে অটোতে করে নিয়ে যায়। সিজারের পর আমার বাচ্চাকেও দেখতে দেয়নি। আমি যখন বাচ্চার কথা জিজ্ঞেস করি, তখন ক্লিনিকের লোকজন জানান, আমার বাচ্চা শাহিন বিক্রি করে দিয়েছেন।

পরে ক্লিনিক থেকে ফিরে এলাকায় শাহিনের খোঁজ করেন আয়েশা আক্তার। কিন্তু তার খোঁজ পাচ্ছিলেন না।

তিনি আরও বলেন, একদিন স্কুলের মাঠে তাকে পেয়ে বাচ্চার কথা জিজ্ঞেস করি। তখন তিনি বলেন, তুই বাচ্চা বিক্রি করে দিয়েছিস, স্ট্যাম্পে স্বাক্ষরও করেছিস। এটা নিয়ে বেশি কথা বললে ছালায় (বস্তা) ভরে যমুনায় ভাসিয়ে দেব। তাই ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারছিলাম না।

আয়েশা বলছিলেন, এমন সময় কিছুদিন আগে ফৌজিয়া নানীকে একদিন আমার এই ঘটনা খুলে বলি। তখন তিনি আমার কথা রেকর্ড করে বিভিন্ন জায়গায় দেয়। এটা জানার পরপর শাহিন নানা ও তার ছেলে এসে আমাদের অনেক গালমন্দ করে। মেরে ফেলার হুমকিও দেয়।

এ বিষয়ে আয়েশার নানি আছিয়া খাতুন বলেন, আয়েশার পেটে বাচ্চা থাকার সময় প্রতিদিন শাহিন বাড়িতে আসতো। এসে বলত ওকে নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাব।ওখানে গিয়ে সিজার করে নিয়ে আসব। আমি শুনে বলতাম ভাই আপনি কেন নিয়ে যাবেন। তখন তিনি বলতেন, সমস্যা কী আমি ওর সিজার করাব।

আছিয়া আরও বলেন, শাহিন প্রতিদিন ফলমূল নিয়ে আসতো। এটা নিয়ে তাকে প্রশ্ন করা হত। ফল কেনার টাকা কে দিয়েছে? কিন্তু শাহিন বলত তিনি নিজেই ফল কিনতেন আয়েশার জন্য।

বেলকুচি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফৌজিয়া বীথি বলেন, আয়েশা গর্ভবতী ছিল এটা জানতাম। একদিন তার কোলে বড় একটা শিশু দেখে তার নিজের সন্তানের খবর জানতে চাই। তখন তিনি আমাকে ঘটনা খুলে বলেন। আমি সেই কথা মোবাইলে ভিডিও রেকর্ড করি। এটা জানার পর শাহিন, যিনি আমার স্বামীর বড় ভাই, আমাকে অশ্লীল ভাষায় গালি দেন, মেরে ফেলার হুমকি দেন। এখন আয়েশা তার সন্তানকে আপাতত ফিরে পেলেও শঙ্কা কাটেনি। কারণ অভিযুক্তদের কাউকেই পুলিশ আটক করেনি। এতে আয়েশা তার নানি যেমন হুমকিতে আছে, তেমনি আমিও আছি।

তবে কত টাকায় আয়েশার সন্তান বিক্রি হয়েছে সেটার সঠিক তথ্য তারা জানেন না।

বিষয়টি থানা পুলিশের কাছে অভিযোগ করার পর ওই শিশুর খোঁজ মিলে ধুনট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ডায়রিয়া ও সর্দি-কাশিতে অসুস্থ দেখিয়ে ইয়াছিন নামে এক ব্যক্তি ভর্তি করায় শিশুটিকে। ভর্তির সময় নবজাতক শিশুটির নাম উল্লেখ করা হয় ফারদিন। কিন্তু ভর্তির পরপরই তিনি উধাও হয়ে যান। ওই সময় ইয়াছিন নামের মোবাইল নম্বরে ফোন দেওয়া হলে সেটি বন্ধ দেখায়। নবজাতককে উদ্ধারের পর ২২ ফেব্রুয়ারি আদালতের মাধ্যমে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেয় পুলিশ।

এ ঘটনা নিশ্চিত করে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা দিবাকর বসাক বলেন, ১৭ ফেব্রুয়ারি দুই মাস ২০ দিন বয়সী একটি নবজাতক শিশুকে আমাদের এখানে ভর্তি করানো হয়। এর কিছুক্ষণ পর পুলিশ একজন মহিলাকে নিয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে শিশুটির প্রকৃত মা হিসেবে ওই মহিলাকে উপস্থাপন করে পুলিশ। পরবর্তীতে শিশুটি গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন ছিল। সুস্থ হলে শিশুটিকে আদালতে নিয়ে যায় পুলিশ।      

তবে থানায় অভিযোগ দেওয়ার পর থেকেই অভিযুক্তরা সবাই পলাতক রয়েছেন। তারা কেউ এলাকায় নেই বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। সিজারের বিষয়টি জানতে শেরপুরের খেজুরতলা এলাকায় অবস্থিত মাহবুব ক্লিনিকে গেলে তারাও বিষয়টি স্বীকার করেন। ক্লিনিকের এক পরিচালকের পরিচিত হওয়ার সুবাদে এই ক্লিনিকে আয়েশাকে নিয়ে আসেন শাহিন।

ক্লিনিকের ব্যবস্থাপক আয়নাল হক বলেন, শাহিন নামে এক ব্যক্তি ওই মহিলাকে ভর্তি করেছিলেন। সন্তান হওয়ার পর আরও কয়েকদিন ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন ছিলেন আয়েশা। কিন্তু এখান থেকে কোনো বাচ্চা বিক্রি করা হয়নি। ক্লিনিক কর্তৃপক্ষও এর সঙ্গে জড়িত না।

সার্বিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে ধুনট থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সৈকত হাসান বলেন, জন্মের প্রায় দুই মাস পর ওই নবজাতক শিশুকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে উদ্ধার করা হয়। পরে আদালতের মাধ্যমে নবজাতককে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।এ ঘটনায় কেউ আটক হয়নি। তবে মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। তদন্তের পর বিস্তারিত জানানো হবে।

আসাফ-উদ-দৌলা নিওন/এএএ