লক্ষ্মীপুর জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা নিয়মিত এবং সময়মতো কার্যালয়ে আসেন না বলে অভিযোগ করেছেন সেবাপ্রত্যাশীরা। এর ফলে পশুপাখিকে চিকিৎসাসেবা দেন অফিস সহায়ক ও ড্রেসার। সম্প্রতি সরেজমিনে ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনেও এমন চিত্র ফুটে উঠেছে।

শহরের দক্ষিণ তেমুহনী এলাকায় জেলা ও উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় এবং ভেটেরিনারি হাসপাতালটি অবস্থিত।

গত বৃহস্পতিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) কার্যালয়ে গিয়ে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. কুমুদ রঞ্জন মিত্রকে পাওয়া যায়নি। দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেও তিনি আসেননি। অফিসে দায়িত্বে থাকা লোকজনও তার মোবাইল নম্বর দিতে রাজি হননি। এর আগে মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি) বেলা ১১টার দিকে গিয়েও তাকে কার্যালয়ে দেখা যায়নি।

অন্যদিকে অতিরিক্ত জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মাহমুদা সুলতানার কক্ষে তালা ঝুলানো ছিল। তবে তিনি সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্বে রয়েছেন। এতে উপজেলা কার্যালয়েই তিনি বসেন। মঙ্গলবার তিনি কার্যালয়ে থাকলেও কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি। বৃহস্পতিবার পুনরায় প্রতিবেদককে যেতে বললেও এদিন তিনি কার্যালয়ে আসনেনি। এ সময় মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদককে বলেন, গলায় ঠান্ডা লাগার কারণে কার্যালয়ে আসতে পারিনি। আর চিকিৎসাসেবায় এগুলো স্বাভাবিক ঘটনা। এ নিয়ে সংবাদ করার কিছু নেই।

পশুপাখির সেবা করাতে আসা কয়েকজন নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনেকেই প্রথমবারের মতো প্রাণিসম্পদ হাসপাতালে এসেছেন। কে ডাক্তার, কে অফিস সহায়ক আর কে ড্রেসার কাউকেই চেনেন না তারা। বিনামূল্যে চিকিৎসা পেয়ে তারাও খুশি। কারণ তারা অফিস সহায়ক-ড্রেসারকে চিকিৎসক বলেই মনে করেছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, রাকিব হোসেন নামের এক কিশোর তিনটি ছাগলের বাচ্চা নিয়ে জেলা ও উপজেলা ভেটেরিনারি হাসপাতালে আসে। বিনামূল্যে ও নিরাপদ হওয়ায় হাসপাতালে ছাগলগুলোকে খতনা (খাসি) করানোর জন্য এনেছে। কিছুক্ষণ পরই ছাগলের বাচ্চাগুলোকে সদর উপজেলা ভেটেরিনারি হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত ড্রেসার মো. মুরশিদ আলম খতনা করান। পরে ছাগলগুলোকে তিনিই ইনজেকশন দিয়েছেন।

এরই মধ্যে নজরে পড়ে আরেকজনের একটি ছাগল বাচ্চা প্রসব করেছে। আর এটি করাচ্ছেন জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের অফিস সহায়ক শহিদুল ইসলাম। কিন্তু তাও উন্মুক্ত স্থানে। এ ছাড়া হাসপাতালে সেবার উদ্দেশ্যে আনা গরু, ছাগল, মুরগিকে তাদেরকেই চিকিৎসা দিতে দেখা গেছে। তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

এদিকে পাশাপাশি দুটি কার্যালয়ের সামনে দুটি পতাকার দণ্ড দেখা যায়। তবে দুটি দণ্ডই খালি, কোনোটিতেই পতাকা দেখা যায়নি।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি হাসপাতালে গেলে একটি বিড়াল কোলে নিয়ে বেঞ্চে বসে থাকতে দেখা যায় উমা দেবনাথ নামের এক গৃহবধূকে। ২২ ফেব্রুয়ারি গিয়েও তাকে দেখা গেছে। ক্যামেরায় কথা না বললেও তিনি জানান, তার বিড়ালের নাম অ্যাঞ্জেল। বিড়ালের চিকিৎসার জন্য তিনি এসেছেন। চিকিৎসক না থাকায় তাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

মুরগির ভ্যাকসিনসহ ওষুধ নিতে আসা নাছিমা আক্তার আঁখি ও তার ননদ শাবনাজ আক্তার ঢাকা পোস্টকে জানান, টাকা দিয়েই মুরগির জন্য ভ্যাকসিন ও ওষুধ নিতে টুমচর গ্রাম থেকে এসেছেন তারা। এর মধ্যে শাবনাজ আরও কয়েকবার ভ্যাকসিন ও ওষুধ নিয়েছেন। এর জন্য নির্ধারিত ফি দিতে হয়েছে তাদেরকে।

বেলায়েত হোসেন বাচ্চু নামের একজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, চিকিৎসা ঠিক আছে। এখানে এলে মোটামুটি ওষুধ পাওয়া যায়। কিন্তু চিকিৎসকরা নিয়মিত আসেন না। হাসপাতালে এলে তাদেরকে পাওয়া যায় না।

এদিকে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি তথ্যের জন্য লক্ষ্মীপুর প্রেস ক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মীর ফরহাদ হোসেন সুমন ও সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন প্রাণিসম্পদের ওই দুটি কার্যালয়ে যান। তারা গিয়ে দুই কর্মকর্তার একজনকেও পাননি।

ঢাকা পোস্টকে নিজাম উদ্দিন বলেন, নিউজের তথ্যের জন্য সেখানে যাই। কিন্তু ঊর্ধ্বতন দুইজন কর্মকর্তার মধ্যে একজনও ছিলেন না। জেলা কর্মকর্তা একটি প্রশিক্ষণে ঢাকায় রয়েছেন বলে মুঠোফোনে জানিয়েছেন।

জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় এলাকার বাসিন্দা রাজু আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, কয়েক দিন আগে আমি হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন একটি অসুস্থ গরু নিয়ে একজন অসহায় ব্যক্তি হাসপাতালে আসেন। কিন্তু ডাক্তার ছিল না। এতে গরুটি মরে যাবে অবস্থা সৃষ্টি হয়। এটি দেখে ওই ব্যক্তি পার্শ্ববর্তী একটি দোকান থেকে ছুরি এনে গরুটিকে জবাই করেন।

ডাক্তাররা সময়মতো কার্যালয়ে আসেন না বলে জানান রাজু আহমেদ।

বৃহস্পতিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা ৬টা ৪৩ মিনিটে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. কুমুদ রঞ্জন মিত্র মুঠোফোনে ঢাকা পোস্টকে বলেন, কার্যালয়ে এসেছি। তবে দেরি হয়েছে। জনবল সংকট থাকায় সবাই মিলেমিশে কাজ করতে হয়।

পতাকার বিষয়ে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, জাতীয় দিবসগুলোতে পতাকা টানানো হয়। অন্যদিন তেমন টানানো হয় না। তবে পতাকা প্রতিদিন টানানোর জন্য বলে দিয়েছি।

প্রাণিসম্পদ এই কর্মকর্তা বলেন, আমাদের সেবা ও জনবল সংকট নিয়ে নিউজ করলে ভালো হবে। আর উপজেলা কর্মকর্তা (ডা. মাহমুদা সুলতানা) কেন বিষয়টি সহজভাবে নিয়েছেন, তা বলতে পারছি না। আমি উনার সঙ্গে কথা বলব।

জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে সাঁটানো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির তালিকায় দেখা যায়, সরকারিভাবে টিকা প্রদান সম্প্রসারণে গবাদিপশুর সংখ্যা ১ লাখ ৪০ হাজার ও হাঁস-মুরগি ২২ লাখ। বছরে ৯০ হাজার গবাদিপশু, ৪ লাখ ১০ হাজার হাঁস-মুরগি ও ৪০০ পোষা প্রাণীকে চিকিৎসা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। ৭১০টি গবাদিপশু, পাখির রোগ অনুসন্ধানে নমুনা সংগ্রহ ও গবেষণাগারে প্রেরণ করা হবে। ৬২টি গবাদিপশু ও পাখির ডিজিজ সার্ভিলেন্স এবং ২৮টি ফ্রি ভেটেরিনারি মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপনের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে। ২৪ হাজার খামারিকে ও ১০৫ জন মাংস প্রক্রিয়াজাতকারীকে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গবাদি পশুপাখি পালনে সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ১০৫টি উঠান বৈঠকের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।

এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ৭ হাজার ৮০৬টি গবাদিপশু ও ২ লাখ ৫০ হাজার ৮০০ হাঁস-মুরগিকে টিকা দেওয়া হয়েছে। একই মাসে ৭ হাজার ৮৬টি গবাদিপশু, ৪৩ হাজার ৩১৯টি হাঁস-মুরগি ও ৪২টি পোষা প্রাণীকে অন্যান্য চিকিৎসা প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া ৩ হাজার ৬৬৬ জন খামারি ও ১০ জন মাংস প্রক্রিয়াজাতকারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

এমজেইউ