পঞ্চগড় আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে দালালরা বিভিন্ন কৌশলে গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। গ্রাহকদের অভিযোগ, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে সরাসরি গেলে সেবা মেলে না। সিস্টেম বা চ্যানেলে গেলে কোনো ভোগান্তিই থাকে না। কেবল অতিরিক্ত অর্থ গুনলেই দ্রুত মিলে কাঙ্ক্ষিত পাসপোর্ট পাওয়ার সেবা।

সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদক পঞ্চগড় আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ে গ্রাহক হয়ে গেলে মিলে বিভিন্ন তথ্য। পরিচয় গোপন রেখে প্রতিবেদক পাসপোর্ট অফিসে যেতেই এগিয়ে আসেন দু-তিনজন দালাল। এসেই বলেন, পাসপোর্ট করতে এসেছেন? হ্যাঁ বলতেই বলেন, চলেন আমার কম্পিউটার সেন্টারে। কত বছরের পাসপোর্ট, কত টাকা খরচ জানতে চাইলে বিভিন্ন রেট জানান। কাগজপত্র সমস্যার কথা জানালে বলেন, কোনো সমস্যাই নেই। পাসপোর্ট অফিসে আমাদের লোক আছে। সব ঠিক হয়ে যাবে। চলেন ফাইলটা রেডি করি। এভাবেই দিনভর বিভিন্ন দালালের কাছে গিয়ে জানা যায় নানা তথ্য।

সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে পাসপোর্ট করতে আসা সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, সরাসরি পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে গেলে সহজে সেবা মিলে না। পাসপোর্ট করার জন্য নিজে সব রেডি করে নিয়ে গেলে ‘এই ভুল’, ‘সেই ভুল’ ধরে হয়রানি করেন। তাই ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে বেশির ভাগ গ্রাহক দালালের মাধ্যমে পাসপোর্ট করেন। পাসপোর্ট করতে আসা গ্রাহকরা সরাসরি সাংবাদিকদের সঙ্গেও কথা বলতে চান না পাসপোর্ট না হওয়ার ভয়ে।

পঞ্চগড় আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস ঘুরে দেখা যায়, আশপাশে গড়ে উঠেছে বেশকিছু কম্পিউটার দোকান। এসব দোকানে অনলাইন আবেদন করতে দেখা যায় গ্রাহকদের। এসব কম্পিউটারের ব্যবসায়ীরাই পাসপোর্ট অফিসের দালাল হিসেবে কাজ করছেন। তারা পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে চ্যানেলের মাধ্যমে কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছেন নির্ধারিত ফি’র চেয়ে অতিরিক্ত টাকা। সেবাপ্রার্থীদের অভিযোগ, পাসপোর্টের জন্য ব্যাংক ড্রাফট ও পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে বিভিন্ন অঙ্কের অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছেন দালালরা।

সেবাপ্রার্থীরা সরাসরি পাসপোর্ট করতে গেলে পড়েন বিভিন্ন ঝামেলায়। আবেদনে ভুল, এনআইডির নাম, বাবার নামসহ বিভিন্ন ভুলের অজুহাতে বিভিন্ন প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। কিন্তু দালালদের মাধ্যমে কাজ করালে ভোগান্তি ছাড়াই মিলে সেবা। এজন্য গুনতে হয় অতিরিক্ত টাকা। ফাইল প্রসেসিং-এর বাইরে ভোগান্তি পোহাতে না চাইলে ১ হাজার ৩০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা দিলেই বেশ সহজে মিলে যাবে সেবা।

পাসপোর্ট অফিসে দালালমুক্ত থাকার কথা থাকলেও পাসপোর্ট কার্যালয়ে দেখা যায়, দালালরাই গ্রাহকদের ফাইল জমা দিচ্ছেন। আবার কিছু সচেতন গ্রাহক নিজেই এসে ফাইল জমা দিচ্ছেন।

দেবীগঞ্জ থেকে পাসপোর্ট করতে আসা তৈয়ব আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাসপোর্ট করতে এসেছিলাম। কিন্তু দুপুর ১টা বেজে যাওয়ায় আমার ফাইল আর নেওয়া হলো না। অনেক দূর থেকে এসেছি বলার পরও কাজটি হলো না। এখন বলছে আবার আসতে হবে।

রবিউল ইসলাম নামের একজন বলেন, আমি দ্বিতীয়বারের জন্য পাসপোর্ট করতে এসেছি। দালাল ছাড়া তো কাজ সহজে হয় না। তাই দালালের মাধ্যমেই কাজ করতে হচ্ছে।

রবিউলের মতো অনেক গ্রাহক রয়েছেন, যারা ভোগান্তি পোহাতে না চেয়ে দালালের মাধ্যমেই সেবা নিচ্ছেন। আর গুনছেন অতিরিক্ত টাকাও।

বোদা উপজেলা থেকে আসা জাকির হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা দুটি পাসপোর্ট করতে এসেছিলাম। কয়েক দিন ধরেই ঘুরছি। এখানে দালাল তো আছেই, গেটের আনসাররা পর্যন্ত বকশিশ নিয়ে থাকেন। কাজ করালাম, কিন্তু কিছু টাকা বেশি দিতেই হলো।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও কয়েকজন গ্রাহক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা কয়েকজন একসঙ্গে পাসপোর্ট করতে এসেছি। এখানে দালাল ছাড়া কাজ করতে গেলে অনেক ভোগান্তি পেতে হয়। সব জায়গায় টাকা দিতে হয়। ভোগান্তি ছাড়া সহজে সেবা পেতে হলে চ্যানেলের মাধ্যমে গেলে ভালো হয়। কাগজপত্র ভুল হলেও টাকায় ছাড় পাওয়া যায়।

চ্যানেল বা সিস্টেমটা আসলে কী জানতে চাইলে তাদের মধ্যে একজন বলেন, পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দালালদের যোগসাজশ রয়েছে। গ্রাহকরা সরাসরি ফাইল নিয়ে গেলে কর্মকর্তারা বিভিন্ন ভুল ধরে ফেরত পাঠান। আর দালালদের টাকা দিলে ফাইলে একটি সাংকেতিক চিহ্ন দিয়ে দিলে সেটি পাসপোর্ট কর্মকর্তারা বুঝে নেন। টাকা না দিলে ভুল ধরিয়ে টাকা নেওয়ার কৌশল তৈরি করেন। সাধারণ গ্রাহকরা এভাবেই বিভিন্নভাবে ভোগান্তির শিকার হয়ে থাকেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুজন দালাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা সেবা দিয়ে থাকি। আসলে সিস্টেম ছাড়া কাজ তাড়াতাড়ি করা সম্ভব না। কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে কাজ করতে হয়। সাধারণ পাসপোর্ট করতে ৫-৬ হাজার টাকা নিয়ে থাকি। এর মধ্যে ব্যাংক ড্রাফট ৪ হাজার ২৫ টাকা, অনলাইনে আবেদন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। আর পুলিশ ভেরিফিকেশনেও টাকা দিতে হয়। দ্রুত সুবিধা পেতে পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের টাকা দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে হয়।

পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনের বিষয়ে জানতে চাইলে দালালরা বলেন, পাসপোর্ট আবেদনকারীদের ভেরিফিকেশনের জন্য আমাদের মাধ্যমে টাকা না দিলে সরাসরি পুলিশ আবেদনকারীর বাড়িতে গেলে তারা কীভাবে খুশি করবেন তাদের ব্যাপার। কিন্তু আমাদের কাছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা জমা দিলে পুলিশ ভেরিফিকেশনে তাদের আর ঝামেলা থাকে না। পুলিশ তাদের বাড়িতে যাবে না। আমরা শুধু ফাইলটা আর টাকাটা পাঠিয়ে দিলে ভেরিফিকেশন হয়ে যাবে। সেবাপ্রার্থীদের কোনো ঝামেলা থাকবে না।

পাসপোর্ট অফিসের সিটিজেন চার্টারের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ বছর মেয়াদের ৪৮ পৃষ্ঠার পাসপোর্ট নিতে নিয়মিত বিতরণ (২১ দিন) এর জন্য ৪ হাজার ২৫ টাকা (বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আবেদনের ক্ষেত্রে ১৫% ভ্যাটসহ) ফি জমা দিতে হবে। জরুরি বিতরণ (১০ দিন) ৬ হাজার ৩২৫ টাকা ও অতীব জরুরি বিতরণ (৩ দিন) ৮ হাজার ৬২৫ টাকা। অপরদিকে ১০ বছর মেয়াদের ৪৮ পৃষ্ঠার পাসপোর্ট নিতে হলে ২১ দিনে নিলে ৫ হাজার ৭৫০ টাকা, ১০ দিন (জরুরি) ৮ হাজার ৫০ টাকা ও ৩ দিনে (অতীব জরুরি) ১০ হাজার ৩৫০ টাকা গুনতে হবে।

আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পঞ্চগড় জজকোর্ট এলাকায় আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসটি ভাড়ায় পরিচালিত হয়। পরে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জেলার হাড়িভাসা রোডে নিজস্ব অফিসে কার্যক্রম শুরু করে। ২০২৩ থেকে এ পর্যন্ত কার্যালয়ে পাসপোর্টের আবেদন পড়েছে ১২ হাজার। নতুন বছরেই হাজারের বেশি আবেদন পড়েছে। প্রতিদিন গড়ে ৩৫-৪০টির মতো আবেদন জমা হয়।

পঞ্চগড়ের জ্যৈষ্ঠ সাংবাদিক শহীদুল ইসলাম শহীদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাসপোর্ট সেবা আগের থেকে অনেক স্মার্ট হয়েছে। তবে পাসপোর্ট করতে গিয়ে এখনও ভোগান্তিতে পড়তে হয়। ছোট ছোট ভুল ধরে দালালদের মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার একটা সিস্টেম চলে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে পঞ্চগড় আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক এনায়েত উল্ল্যা’র সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।

পঞ্চগড় ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্টের সুপারিনটেনডেন্ট মোহাম্মদ মৃদুল ভূঁইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাসপোর্ট কার্যালয় একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের নাগরিকদের পাসপোর্ট দেওয়া আমাদের কাজ। পাসপোর্ট করতে এসে সর্বপ্রথম অনলাইনে আবেদন করে ব্যাংকে টাকা জমা দেবেন। এর সঙ্গে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে এসে পাসপোর্ট অফিসে জমা দেবেন। পাসপোর্ট অফিসে যে কর্তব্যরত কর্মকর্তা থাকবেন তিনি তা জমা নেবেন। এখানে ভোগান্তির কোনো কিছু নেই। যদি কাগপত্র ঠিক থাকে তাহলে যেকোনো ব্যক্তিই পাসপোর্ট করতে পারবেন। এখন পাসপোর্ট অফিসে এসে সেবা নিয়ে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন এরকম লোক খুবই কম।

তিনি আরও বলেন, অনেকে বাইরে থেকে ধারণা করেন যে, পাসপোর্ট অফিসে ঘুষ ছাড়া কাজ হয় না। কিন্তু পাসপোর্ট অফিসে এসে কতজন লোক সেবা না পেয়ে ফিরে গেছে সেই সংখ্যাটা জানা নেই। থাকলেও খুবই কম। তাই মনে করি আপনারা পাসপোর্ট অফিসে আসুন, দেখুন আমাদের সেবাসমূহ। তারপর আপনাদের যদি কোনো অভিযোগ থাকে জানাতে পারেন।

পুলিশ ভেরিফিকেশনের বিষয়ে জানতে চাইলে পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এসএম শফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা শুধু পাসপোর্ট অফিসের ভেরিফিকেশনটাই করি। পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য দালালের মাধ্যমে টাকা নিয়ে থাকে এটা সত্য নয়।

সার্বিক বিষয়ে পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো.জহুরুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটা পাসপোর্ট অফিস ও পুলিশের কাজ। তারপরও অনিয়ম-হয়রানির অভিযোগ পেলে বিষয়টি দেখা হবে।

এমজেইউ