গত ১৫ বছর ধরে বাড়িতে গরু পালন করছেন নূর নাহার বেগম। যেকোনো সমস্যা দেখা দিলে স্থানীয় গ্রাম্য চিকিৎসক এনে টাকা দিয়ে চিকিৎসা করান। স্থানীয়ভাবে সরকারি পশু চিকিৎসক বিনা মূল্যে সেবা দেন এ ব্যাপারে তিনি তেমন জানেনও না। এভাবে বাড়িতে পশুপালনে নিজের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার কথা জানান ফেনীর পরশুরাম উপজেলার বীরচন্দ্রনগর গ্রামের নূর নাহার বেগম। তার মতো একই সুরে কথা বলেছেন জেলার প্রান্তিক পর্যায়ে পশুপালনে সংশ্লিষ্ট অনেকেই।  

জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ফেনী জেলায় গবাদিপশুর মধ্যে গরু, মহিষ, ভেড়া ও ছাগল রয়েছে ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৯২৩টি এবং হাঁস-মুরগি রয়েছে ৯৯ লাখ ৭৭ হাজার ২৭১টি। আর এসব পশু চিকিৎসায় ছয় উপজেলার ফুলগাজী ব্যতীত অন্য পাঁচটিতেই নেই চিকিৎসক। এতে ব্যাহত হচ্ছে পশুচিকিৎসা কার্যক্রম। 

সূত্র জানায়, জেলায় প্রাণিসম্পদ বিভাগের জনবলকাঠামোয় অনুমোদিত পদ ৮৩টি। এখন জনবল আছে ৪৮ জন। প্রায় ৩৫টি পদ শূন্য। 

ফেনী সদর উপজেলার ইজ্জতপুর এলাকার বাসিন্দা আবদুর রহিম বলেন, বাড়িতে ৬টি গরু ও ৭টি ছাগল পালন করছি। রোগবালাই সম্পর্কে তেমন ধারণা না থাকায় প্রায় সময় পশু হাসপাতালে আসা হয়। এখান থেকে কিছু ওষুধ লিখে দিলে বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। সরকারিভাবে যদি আরও সহযোগিতা পাওয়া যায় আমরা উপকৃত হব। 

সদর উপজেলা পশু হাসপাতালে স্কুল পড়ুয়া ছেলের বিড়ালের চিকিৎসা নিতে আসেন শহরের একাডেমি এলাকার বাসিন্দা জহির উদ্দিন। নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, হাসপাতাল থেকে ভ্যাকসিনগুলো দেওয়া হয়। অন্যান্য ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়। এ ছাড়া চিকিৎসক না থাকায় স্বয়ং উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা নিজেই চিকিৎসা দিয়েছেন। চিকিৎসক থাকলে আমরা আরও ভালো সেবা পেতাম। 

জেলার পরশুরাম উপজেলার জয়ন্তীনগর গ্রামের খামারি আলমগীর হোসেন বলেন, খামারে বিভিন্ন সময়ে ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মুরগী মারা যায়। তখন অভিজ্ঞ কাউকে এনে টাকা দিয়ে চিকিৎসা করাতে হয়। গত ৭ বছরে কখনো কোনো দপ্তরের সুযোগ-সুবিধা পাইনি। এসব বিষয়ে কেউ কখনো জানতেও চায়নি। সরকারিভাবে যদি আমাদের ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান ও উৎপাদিত পণ্য বিক্রিতে সহায়তা করে তাহলে আরও এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।

চিকিৎসক না থাকায় অসুস্থ পশুর চিকিৎসা দিচ্ছেন উপসহকারী প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা

ছাগলনাইয়া উপজেলার দক্ষিণ সতর নদীর কূল এলাকার বাসিন্দা নূর নবী বলেন, কখনো কোনো ধরনের সহায়তা পাওয়া দূরের কথা, এসব বিষয়ে শুনিওনি। গরুর কোনো সমস্যা দেখা দিলে গ্রাম্য চিকিৎসক বা ফার্মেসি থেকে ওষুধ নিয়ে খাওয়াই। প্রজননকালে এনজিওর লোকদের বাড়িতে এনে এক হাজার থেকে বারো শ  টাকা দিয়ে কৃত্রিম প্রজনন করাতে হয়। 

যোগাযোগে দূরত্বের কারণে ফেনীর সমুদ্র উপকূলীয় উপজেলা সোনাগাজীর প্রাণিসম্পদ বিভাগের সেবাবঞ্চিত চরাঞ্চলের মানুষ। সরকারি ওষুধ, চিকিৎসা, প্রজনন সেবাসহ কোনো সেবাই পাচ্ছে না দেড় লাখেরও বেশি গবাদিপশু। এতে বেসরকারি বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চড়া দামে সেবা কিনতে বাধ্য হচ্ছেন পশুপাখি খামারিরা। 

চরচান্দিয়া এলাকার খামারি জুবায়ের হোসেন রনি বলেন, আমরা বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে টিকে উঠতে পারলেও রোগবালাইয়ের কাছে হার মানতে হচ্ছে। সঠিক চিকিৎসা করতে পারছি না। চরাঞ্চল থেকে উপজেলা প্রাণিসম্পদ হাসপাতালের দূরত্ব ২৫-৩০ কিলোমিটার। গবাদিপশু আনা-নেওয়ার জন্য খরচ গুনতে হয় হাজার টাকার বেশি। সঙ্গে ওষুধ খরচ আছে। এজন্য নিজেরাই অভিজ্ঞতা থেকে চিকিৎসা করি।

চর খন্দকারের মহিষ খামার মালিক শাহজালাল ভূঞা বলেন, পশু হাসপাতালটি উপজেলার এক প্রান্তে হওয়ায় সোনাগাজীর তিন ভাগ মানুষ এ সুবিধা ভোগ করতে পারছে না। উপজেলা সদরে প্রাণিসম্পদ বিভাগের একটি উপকেন্দ্র করা হলে সবাই সমানভাবে সুবিধা ভোগ করতে পারবে।

সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরে গিয়ে দেখা যায়, চিকিৎসক না থাকায় হাসপাতালে আসা অসুস্থ পশুর চিকিৎসা দিচ্ছেন উপসহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (সম্প্রসারণ) মো. ছাদেক মজুমদার। এ ব্যাপারে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, জনবল না থাকায় আমি বাড়তি দায়িত্ব পালন করতেছি। ভেটেরিনারি সার্জন থাকলে আমাকে চিকিৎসা করতে হতো না। ৩ জনের দায়িত্ব একজনে পালন করতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়। শূন্য পদে জনবল নিয়োগ করা গেলে সেবার মান বৃদ্ধির পাশাপাশি কাজের পরিধিও বাড়বে। 

ফেনী সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. শহীদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, উপজেলায় ১১টি সৃষ্ট পদের মধ্যে ভেটেরিনারি সার্জন, কম্পাউন্ডার ও ড্রেসারসহ তিনটি পদই শূন্য। পশুচিকিৎসা সম্পর্কিত প্রধান তিনটি পদে কোনো জনবল না থাকার পরেও আমরা সেবা প্রত্যাশীদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করার চেষ্টা করছি। প্রান্তিক পর্যায়ের পশুপালনকারী ও খামারিদের আধুনিক প্রযুক্তি বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া টিকাদান কার্যক্রমে গুরুত্ব দেওয়ায় আগের চেয়ে অনেক রোগবালাইয়ের সংক্রমণ থেকে পশুপাখি রক্ষা পাচ্ছে। 

প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরে সরকারিভাবে যে ওষুধ দেওয়া হয় সেটি খুবই যৎসামান্য। বরং এরচেয়ে বেশি ওষুধ বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি স্যাম্পল হিসেবে দেয়। এ ছাড়া বাড়িতে গিয়ে চিকিৎসা বা অতিরিক্ত টাকা আদায় ও ওষুধের দাম বেশি রাখার কোনো অভিযোগ পাইনি। এ ধরনের অভিযোগ পেলে দাপ্তরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

এ ব্যাপারে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. মোজাম্মেল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, জেলায় বর্তমানে ৮৩ পদের বিপরীতে ৩৫টি পদ শূন্য রয়েছে। ছয় উপজেলার মধ্যে শুধু ফুলগাজী উপজেলায় ভেটেরিনারি সার্জন কর্মরত আছেন। অন্যান্যদের সহযোগিতায় চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। শূন্য পদে পদায়ন করা হলে আমাদের সার্বিক কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে। এসব শূন্য পদের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আশা করছি খুব শীঘ্রই এ সমস্যা সমাধান হবে।  

চলমান কার্যক্রম প্রসঙ্গে ডা. মো. মোজাম্মেল হক বলেন, বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর পশু পালনের বিষয়ে খামারিদের উদ্বুদ্ধ করতে মাঠপর্যায়ের প্রাণিসম্পদ বিভাগ কাজ করছে। এ ছাড়া গবাদি পশুকে বিভিন্ন ধরনের রোগবালাই থেকে রক্ষা করার জন্য টিকাদান, কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

কৃত্রিম প্রজননে বাড়তি টাকা নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে এ কর্মকর্তা বলেন, কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রমে মাঠপর্যায়ে আমাদের একাধিক প্রশিক্ষিত টিম কাজ করছে। পশুর মালিক অনেক সময় ফোনকলে প্রজনন কার্যক্রমে নিয়োজিত এনজিওর কর্মীকে বাড়িতে নিয়ে যায়। সেক্ষেত্রে কিছু বাড়তি টাকা দেওয়ার ঘটনা ঘটে। তবে সুনির্দিষ্টভাবে এ ধরনের অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

দুর্যোগকালীন কর্মকাণ্ড ও প্রান্তিক পর্যায়ে সেবা পৌঁছে দেওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, জেলার একমাত্র উপকূলীয় উপজেলা সোনাগাজীতে বিভিন্ন দুর্যোগকালীন সময়ে মেডিকেল টিম গঠন করে পশু চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ ছাড়া চরাঞ্চল বা একদম প্রান্তিক পর্যায়ের সেবা প্রত্যাশীদের জন্য যদি ইউনিয়ন পর্যায়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা যায় তাহলে সাধারণ মানুষ বেশি উপকৃত হবে। 

এএএ