থরথর করে কাঁপে হাত-পা। প্রতিটি কদম ফেলতে সময় লাগে মিনিট খানেক। এরপরও সকাল হলেই বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে রিকশার হাতল ধরে রোজগারের উদ্দেশ্যে বের হতে হয় ৮০ বছরের বৃদ্ধ মন্নান সরদারকে। সড়কে এসে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করলেও তার হাত-পায়ের কাঁপুনি দেখে দুর্ঘটনার ভয়ে কোনো যাত্রী ওঠে না তার রিকশায়।

দীর্ঘ অপেক্ষার পরও কোনো যাত্রী না পেলে রিকশা নিয়েই বিভিন্ন দোকানপাটসহ সচ্ছলদের কাছে সাহায্যের জন্য হাত বাড়ান তিনি। মানুষজনের দেওয়া সাহায্যের টাকা দিয়ে স্ত্রীর ওষুধপত্র কেনার পর চাল-ডাল কেনার টাকা না থাকলে উপোস থাকতে হয় মন্নান ও তার স্ত্রী ফুলমালাকে। 

সম্প্রতি মন্নান সরদারকে শরীয়তপুর পৌর বাসস্টান্ড এলাকায় রিকশা নিয়ে সাহায্য তুলতে দেখা গেছে। পেশায় রিকশাচালক মন্নান সরদার শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার ছয়গাঁও ইউনিয়নের পাপরাইল গ্রামের বাসিন্দা। মন্নান সরদার ও ফুলমালা বেগম দম্পতির চার মেয়ে থাকলেও নেই কোনো ছেলে সন্তান।

জানা যায়, ৮০ বছর বয়সী মন্নান সরদার জীবনের ৬০ বছরই রিকশা চালিয়ে উপার্জন করেছেন। উপার্জনের টাকা দিয়ে সারা জীবন সংসারের ব্যয় বহন করতে পারলেও গত ৬ মাস ধরে স্ট্রোকজনিত কারণে অসুস্থতায় ভুগছেন তিনি। নিজের জায়গা-জমি বিক্রি করে চার মেয়েকে বিয়ে দিতে হয়েছে বলে এখন বৃদ্ধ বয়সে তার কোনো সম্বল নেই। ৭০ বছর বয়সী স্ত্রী ফুলমালাসহ মন্নান সরদার নিজেও বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছেন। স্ত্রী ফুলমালার জন্য প্রতিদিন ১২০ থেকে ১৫০ টাকার ওষুধ প্রয়োজন হয়।

স্বামী-স্ত্রী দুইজনেই বয়স্ক ভাতার জন্য উপযুক্ত হলেও স্ত্রী ফুলমালা বয়স্ক ভাতা পান না। ভিক্ষাবৃত্তিকে ঘৃণা করেন মন্নান সরদার। কিন্ত বয়সের এই প্রতিকূল অবস্থায়ও ক্ষুধার তাগিতে প্রতিনিয়তই হাত বাড়াতে হয় অন্যের দুয়ারে। ৬০ বছর রিক্সা চালিয়ে স্ত্রী ফুলমালাসহ সকলের ব্যয়ভার বহন করা সংগ্রামী এই মানুষটা বার্ধক্যের কাছে হার না এখনো সংসার পরিচালনায় যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। একটি ছেলে সন্তান না থাকায় বৃদ্ধ বয়সেও উপার্জনের জন্য মানুষের কাছ থেকে সাহায্য নিতে হয় তার বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

রিকশা চালিয়ে সাহায্য নেওয়া মন্নান সরদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১০ বছর বয়স থেকে রিকশা চালাই। জমি বিক্রি করে মেয়েদের বিয়ে দিতে হয়েছে। আমার কোনো ছেলে নেই। ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় রিকশা চালিয়েছি। সারাটা জীবন কারও কাছে হাত পাততে হয়নি আমার। কিছু দিন আগে স্ট্রোক করেছি বলে এখন মানুষ ভয়ে আমার রিকশায় ওঠে না। তাই বাধ্য হয়েই রিকশার যাত্রী না পেলে সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দেই। ঘরে অসুস্থ স্ত্রীর জন্য প্রতিদিন ১০০ থেকে ১২০ টাকার ওষুধ লাগে। মানুষ সাহায্য না দিলে আমার খুব কষ্ট হয়।

নুরুল ইসলাম মাল নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি ঢাকা পোস্টকে বলেন, যাত্রী পেলে মন্নান সরদার কারও থেকে সাহায্য নেয় না। তবে বয়স হওয়ার কারণে তার হাত-পা অনেক কাঁপার ফলে দুর্ঘটনায় তার রিকশায় কেউ ওঠে না। আমরা প্রায়ই তাকে সাহায্য করে থাকি, সাহায্যের টাকা দিয়ে সে স্ত্রীর জন্য ওষুধপত্র ও সংসারের খরচ বহন করে।

বিষয়টি নিয়ে ছয়গাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান লিটন ঢাকা পোস্টকে বলেন, মন্নান সরদার পরিষদ থেকে বয়স্কভাতা পায়। ইউনিয়ন পরিষদের অন্যান্যরা সুবিধাও তাকে প্রদান করা হবে।

ভেদরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজিবুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মন্নান সরদার আবেদন করলে বিস্তারিত খোঁজখবর নিয়ে তার পাশে থাকবে উপজেলা প্রশাসন।

সাইফ রুদাদ/আরএআর