একই রোগে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন তিন ভাই
নাসির, রফিক ও বশির তিন ভাই। জন্ম আগে পরে হলেও এখন তারা মৃত্যুর প্রহর গুনছেন একসঙ্গে। প্যারালাইসিস জাতীয় এক ধরনের রোগ তাদের তিন ভাইয়ের জীবনের আনন্দ কেড়ে নিয়েছে। একই রোগে চোখের সামনে বাবা, চাচাসহ অন্য ভাই-বোনদের মরতে দেখেছেন নাসিরেরা। অথচ তাদের সবার জীবনের শুরুটা ছিল অন্য আর দশজনের মতোই স্বাভাবিক।
অভিশপ্ত এ রোগে সুখ আর আনন্দে ভরা পরিবারের সদস্যরা একে একে মৃত্যুবরণ করেছেন। সেই একই রোগে আক্রান্ত হয়ে এখন মৃত্যু পথযাত্রী নাসির, রফিক ও বশির। মঙ্গলবার (২০ এপ্রিল) দুপুরে রংপুর নগরীর মাহিগঞ্জ আমতলা সংলগ্ন ট্যাকসোর দিঘী গ্রামে গিয়ে দেখা মিলে ওই তিন ভাইয়ের। তাদের কারও মুখে হাসি নেই। অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় সারাক্ষণ কাঁপতে কাঁপতে একেকটি দিন কেটে যাচ্ছে তাদের।
বিজ্ঞাপন
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আমতলা ট্যাকসোর দিঘী গ্রামের মৃত দেলোয়ার হোসেনের ছেলে নাসির হোসেন (৪৪), রফিকুল ইসলাম (৪২) ও বশির আহমেদ (৪০)। দেলোয়ার হোসেন ১৯৯০ সালে প্রথম এক ধরনের প্যারালাইসিস রোগে আক্রান্ত হন। এ রোগের কারণে একজন ব্যক্তি নিজেকে স্থির রাখতে পারেন না। সারাক্ষণ কাঁপতে থাকেন। দেলোয়ার হোসেন দীর্ঘ পাঁচ বছর ওই রোগ আক্রান্ত থাকার পর ১৯৯৫ সালে মারা যান।
দেলোয়ারের মৃত্যুর পর তার আরেক ভাই নূর ইসলামও একই রোগে আক্রান্ত হন। বিভিন্নভাবে চিকিৎসা করান। কিন্তু তাকেও বাঁচানো সম্ভব হয়নি। একইভাবে নূর ইসলামের ছেলে জামাল হোসেন, মেয়ে রেহেনা ও নাজমা বেগমও প্যারালাইসিস জাতীয় ওই একই রোগে আক্রান্ত হন। দীর্ঘদিন রোগাক্রান্ত থাকার পর একে একে তাদের সবাই মারা যান।
বর্তমানে দেলোয়ার হোসেনের তিন ছেলে নাসির, রফিক ও বশির এবং মেয়ে রোকসানা এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বৈবাহিক কারণে রোকসানা শ্বশুরবাড়িতে রয়েছেন। তবে আক্রান্ত তিন ভাই একই বাড়িতে অবস্থান করছেন। বড় ভাই জাকির হোসেন তিনজনকে দেখাশোনা করছেন।
ঘাতক এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর রফিক ও বশিরের সংসারে আন্ধকার নেমে এসেছে। তাদের দূরারোগ্য ব্যাধিতে পাশে না থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন স্ত্রী-সন্তানরা। রফিক ও বশিরের স্ত্রী এবং দুই সন্তান বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। আজও তারা ফিরে আসেননি। বাধ্য হয়েই অসুস্থ ভাইদের নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন তাদের বড় ভাই জাকির হোসেন। বর্তমানে জাকিরের বাড়িতেই রয়েছেন তিন ভাই।
জাকির হোসেন জানান, তিন ভাইয়ের রোগের চিকিৎসার জন্য তিনি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। কিন্তু চিকিৎসক বলেছেন এ রোগের চিকিৎসায় সুস্থ হওয়ার সুযোগ কম। চিকিৎসা ব্যয়ও অনেক। তাদের আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় চিকিৎসা করানো সম্ভব হচ্ছে না।
বর্তমানে জাকির তার তিন ভাইকে নিয়ে মানসিক ও আর্থিকসহ বিভিন্ন সংকটে চরম দুঃশ্চিন্তায় দিনাতিপাত করছেন। তাদের পৈত্রিক খড়ের বাড়ি ছাড়া অন্য কোনো জমিজমাও নেই। যা বিক্রি করে ভাইদের চিকিৎসা করাবেন। দিনমজুরি করে কোনো রকমে ভাইদের দেখাশুনা করছেন। সমাজের বিত্তবান ও হৃদয়বান ব্যক্তিরা এগিয়ে আসলে অসুস্থ তিন ভাই ও বোনের চিকিৎসা করানো সম্ভব বলে জানান জাকির হোসেন।
ওই এলাকার আমতলা বিদ্যাপীঠের অধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা পোস্টকে জানান, ওই পরিবারে বর্তমানে চারজন প্যারালাইসিস জাতীয় রোগে ভুগছেন। তাদের পাশে অনেকেই সহায়তার হাত বাড়িয়েছিল। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য। এখন ওই বাড়িতে গেলে তিন ভাই শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তাদের চিকিৎসা ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য দানশীল ব্যক্তিদের পাশাপাশি সরকারি সহায়তা প্রয়োজন।
এ ব্যাপারে রংপুর সিটি করপোরেশনের ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মুক্তার হোসেন ঢাকা পোস্টকে জানান, ওই পরিবারের সদস্যদের প্যারালাইসিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি তিনি জানেন। তাদের সবাই পারিবারিকভাবে এই রোগে আক্রান্ত। বিভিন্ন সময়ে তিনি সাধ্যমত তাদের সহায়তা দিয়েছেন। তাদের চিকিৎসার জন্য সিটি করপোরেশন থেকে যদি সম্ভব হয় অনুদানের ব্যবস্থা করবেন।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর