বিআরটিএ অফিসের ভেতর বসে আছেন দালাল রাব্বি - ছবি : ঢাকা পোস্ট

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) নাটোর অফিসে অনিয়ম-দুর্নীতি যেন থামছেই না। গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ও ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে গেলে ভোগান্তি পোহাতে হয় সেবাগ্রহীতাদের। দ্রুত কাজ করে দেওয়ার কথা বলে তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন দালালরা। অফিসটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে দালালদের সক্রিয় সিন্ডিকেট।

যদিও সাধারণ জনগণকে সেবা দেওয়াই বিআরটিএর লক্ষ্য। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় বাধা এসব সিন্ডিকেট ও বিআরটিএ অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। 

নাটোর বিআরটিএ সূত্রে জানা যায়, জেলায় নিবন্ধিত মোট মোটরসাইকেলের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। আর অফিসে তথ্য আছে এমন অন্যান্য ভারি যানবাহনের সংখ্যা দুই শর মতো। প্রতি মাসে নবায়নসহ গড়ে প্রায় ৮০০ জন এই অফিস থেকে নতুন করে ড্রাইভিং লাইসেন্স করেন।

সূত্রে জানা যায়, দালালদের অধিকাংশ গোপনে কাজ করলেও কিছু প্রভাবশালী দালাল প্রকাশ্যে নাটোর বিআরটিএ অফিস চষে বেড়ান।‌ সরেজমিনে গিয়ে ডিসি অফিসের এক কর্মচারী, বিআরটিএ অফিসের স্টাফ পরিচয় দেওয়া এক সহকারী, কোর্ট চত্বরে অবস্থিত কয়েকটি কম্পিউটার ও ফটোস্ট্যাট দোকানির এসব কাজে জড়িত থাকার সত্যতা মেলে। দালালদের সঙ্গে বিআরটিএ অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশ রয়েছে বলেও অভিযোগ করেন সেবাগ্রহীতারা। 

সরেজমিনে গত বৃহস্পতিবার (১ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে নাটোর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অদূরে অবস্থিত বিআরটিএ অফিসে গিয়ে দেখা যায়- দুপুরের খাবার সময় হওয়ায় বন্ধ বিআরটিএ অফিসের মূল দরজা। তবে  জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল একজন ব্যক্তি অফিশিয়াল কাগজপত্র নিয়ে খুবই ব্যস্ত। কাছে যেতেই দেখা যায় বিআরটিএ অফিসের নথিতে নতুন কিছু তথ্য সংযোজন করছেন তিনি। কিছুক্ষণ পর তিনি বিআরটিএ অফিস থেকে খুব দ্রুত বের হয়ে বাহিরে থাকা জাকির ফটোস্ট্যাটের দোকানে গিয়ে কিছু কাগজপত্র ফটোকপি করলেন। পুনরায় আবার ফিরলেন বিআরটিএ অফিসে। কিছুক্ষণের মধ্যে বেশ কয়েকবার অফিস থেকে জাকির ফটোস্ট্যাটের দোকানে আসা-যাওয়া করেন ওই ব্যক্তি।

তার এমন যাতায়াত ও কর্মকাণ্ডে যে কেউ মনে করবেন তিনি বিআরটিএ অফিসের পিয়ন। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা যায়- ওই ব্যক্তি বিআরটিএ অফিসের পিয়ন নন, তিনি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের একজন কর্মচারী, তার নাম আমিরুল ইসলাম। তিনি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের পাম্প অপারেটর হিসেবে (আউটসোর্সিং) কর্মরত রয়েছেন।

বিআরটিএ অফিসের খাতায় তথ্য সংযোজন করছেন ডিসি অফিসের কর্মচারী আমিরুল ইসলাম- ছবি : ঢাকা পোস্ট

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি ঢাকা পোস্টকে জানান, আমিরুল ডিসি অফিসের প্রভাব খাটিয়ে দিনের পর দিন বিআরটিএ অফিসে দালালি করেন। অনেক সেবাগ্রহীতাদের সে টাকার বিনিময়ে এ প্রভাব খাটিয়ে দ্রুত কাজ করে দেয়। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি আমিরুল ইসলাম। উল্টো ভিডিও ডিলেট এবং প্রতিবেদন না করার অনুরোধ করেন তিনি। 

এদিন বিআরটিএ অফিসে এসে বিড়ম্বনায় পড়া বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।

সদর উপজেলার আহম্মেদপুর এলাকার মো. মাসুদ রানা বলেন, মোটর ড্রাইভার লাইসেন্সের ফিঙ্গার দিতে এবার দিয়ে তিন বার আসলাম। ঢাকায় চাকরি করি বারবার ছুটিও দিতে চায় না অফিস। আজ সকাল ১০টায় নাটোর বিআরটিএ অফিসে আসছি। ফিঙ্গার প্রিন্টের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়েছি। ওখানে যারা আছে তারা বলছে ১০ মিনিট পরে আসেন। ১০ মিনিট পরে গেলে বলে ৩০ মিনিট পরে আসেন। এরপরে গেলে বলে বিকেলে আসেন। আজকে যদি আমার ফিঙ্গার দিতে না পারি খুব ঝামেলা হয়ে যাবে। এরপর ছুটি চাইলে অফিস বলবে চাকরি করার দরকার নেই।

পুঠিয়ার সাহেব আলী বলেন, মোটরসাইকেলের ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছি ২০১৮ সালে। তার পর থেকে আজ না-তো কাল করতে করতে এতদিন। এর ভেতর কয়েকবার ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে আসছি কিন্তু সে সময় নেয়নি। পুঠিয়ার ঝলমলিয়া এলাকার এক দালাল ধরে আসছিলাম, তারে (দালালকে) বললে সে বলে কাগজপত্রে ত্রুটি ছিল।

তিনি বলেন, আজ সকাল ৮টায় আসছি সবার আগে। সবার আগে আসছি, সবার আগে ফিঙ্গার প্রিন্ট দেব বলে। এখন দেখি আমার পরে এসেও অনেকে ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে গেছে। দালালের সঙ্গে কথা বললাম, সে অফিসে কথা বলে আমাকে জানিয়েছে আজকেই ফিঙ্গার নেবে।

সদর‌ উপজেলার কাঁঠালবাড়ি গ্রামের খোয়াজ উদ্দিন তার মোটরসাইকেল ড্রাইভিং লাইসেন্সের ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে এসেছিলেন। সঙ্গে ছেলে শাখায়াত হোসেনও এসেছেন। ফিঙ্গার প্রিন্ট নেওয়ার রুমের দরজার সামনে বসে ছিলেন ছেলে শাখাওয়াত। এ সময় কথা হয় তার সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গে শাখায়াত বলেন, আমার এক শিক্ষক ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে এসে অনেক বিড়ম্বনায় পড়েন। বার বার পরীক্ষায় ফেল করতেন। কিন্তু আমার বাবা লোক (দালাল) ধরে আসছে। তাই বেশি সমস্যা হয়নি। সহজেই পাস হয়ে গেছে।

এর আগে গত মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) সরেজমিনে গিয়ে দালালদের মাধ্যমে বিআরটিএ অফিসে সেবা নিতে আসা এক গ্রাহকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই গ্রাহক জানান, বিআরটিএ অফিসে তার পরিচিত লোক আছে, সে যে কোনো কাজ করে দেয় অল্প টাকার বিনিময়ে। 

এবার পরিচয় গোপন করে নিজে গ্রাহক সেজে কথা বিআরটিএ অফিসের ওই লোকের সঙ্গে কথা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই গ্রাহক ফোন দিতেই বিআরটিএ অফিস থেকে বের হয়ে আসেন এক যুবক। যুবকের নাম রাব্বি। রাব্বি বিআরটিএ অফিসের স্টাফ নন। তবুও বিআরটিএ নাটোর অফিসে ঢুকতেই বেশিরভাগ সময় তাকে দেখা যায়। এতে সবাই তাকে সেখানকার স্টাফ মনে করেন। 

বিআরটিএ অফিসের উত্তরে একটি চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশন এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে কতো খরচ পড়বে জানতে চাইলে রাব্বি বলেন, রেজিস্ট্রেশনের জন্য পড়বে ১৬ হাজার টাকা। ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য পড়বে সাড়ে ৯ হাজার টাকা। কোনো পরীক্ষায় ফেল করার চিন্তা নেই। এর কাছে (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যক্তি) আমার নম্বর আছে। আমি অফিসে বসি। যে কোনোভাবে যোগাযোগ করা যাবে।'

প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতেই আরও দুই গ্রাহক আসলেন রাব্বির কাছে। তাদের সঙ্গে অল্প সময় কথা বলে রাব্বি অফিসে চলে যান। এদের একজন নাটোর সদর উপজেলার চাঁদপুর মাটিয়াপাড়া এলাকার জনি ড্রাইভার। জনি ড্রাইভার বলেন, বিআরটিএ অফিসের দালানের প্রত্যেকটি ইটও টাকা খায়। কী আর করার!

জনি বলেন, আমার এক পরিচিতজনের ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে দেব, ইনি (রাব্বি) বেশি টাকা চাইলেন। তাই তাকে দিয়ে করাবো না। আমি অন্য মাধ্যমে কাজ করাবো। সেখানে কিছু টাকা কম লাগবে।

বিআরটিএ অফিসে ড্রাইভিং লাইসেন্সের ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে এসেছিলেন লালপুরের দুড়দুড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, গত বছরের সেপ্টেম্বরে বিআরটিএ অফিসে এসেছিলাম ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন করতে। অফিসে আসলে তারা (অফিস কর্মচারীরা) বাহিরে ফটোকপির দোকান থেকে কাগজপত্র (ফরম) পূরণ করে আনতে বলেন। বাহিরে ফারুক ফটোস্ট্যাটের দোকানে গেলে দোকানে থাকা নূর মোহাম্মদ আমাকে বলেন ‘অল্প কিছু টাকা খরচ হবে, আপনাকে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে না। আমরাই সব করে দেব।’

আবুল কালাম আজাদ বলেন,  ঝামেলা এড়াতে তাকে কাগজপত্র এবং টাকা-পয়সা দিয়ে আসি। বেশ কিছুদিন পার হলেও কোনো সাড়া না পেয়ে খোঁজখবর নিয়ে জানলাম আমার কাগজপত্রই জমা দেননি নূর মোহাম্মদ। পরে তাকে অনেক বকাঝকা করার পর কাগজ জমা দেন। এরপর ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে ৪-৫ দিন এসেছি। বারবার বিভিন্ন অজুহাতে ঘুরিয়ে দেয়। এই শীতের সময় ৪০ কিলোমিটার মোটরসাইকেল চালিয়ে আসি, খুব কষ্ট হয়। তাদের কাছে পাত্তাই পাওয়া যায় না।

আনারুল ইসলাম নামে আরেক ট্রাক ড্রাইভার বলেন, ২০২১ সালে ড্রাইভিং লাইসেন্সের (হেভি) জন্য আবেদন করেছি। এখনো ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে পারিনি। অফিসে আসলেই তারা কাগজে স্বাক্ষর দিয়ে বলে এভাবেই চলেন সমস্যা হবে না। এ পর্যন্ত ছয় বার এসেছি। যেদিন আসি সেদিন আর কাজকর্ম কিছু হয় না। 

এ বিষয়ে জেলা সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি রেজাউল করিম রেজা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিআরটিএ অফিসে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ও ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে আসা সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে প্রতিদিন। বছরের পর বছর ঘুরেও লাইসেন্স নবায়ন করতে পারছেন না সেবাগ্রহীতারা। উল্টো বিভিন্ন অজুহাতে হয়রানি করা হচ্ছে তাদের।

তিনি বলেন, অনেক ফিটনেস বিহীন গাড়ি এবং অপেশাদার ড্রাইভাররা মোটা অংকের টাকা দিয়ে দালালদের মাধ্যমে লাইসেন্স পেয়ে রাস্তায় নামার অনুমতি পাচ্ছে। ফলে রাস্তায় দুর্ঘটনা বাড়ছে বহুগুণ।

রেজাউল করিম রেজা বলেন, দিনের পর দিন এসব চলে আসলেও দেখার যেন কেউ নেই। দ্রুত সময়ে দালালদের দৌরাত্ম ও তাদের সহায়তাকারী কর্মচারীদের আইনের আওতায় আনা না গেলে সরকারের এত এত উন্নয়ন এবং সুযোগ-সুবিধা অর্থহীন হয়ে থাকবে। 

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএ নাটোর অফিসের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) এফএইচএম মঈদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, দালালদের দৌরাত্ম আগের থেকে অনেক কমে এসেছে। আমরা এগুলো বন্ধে নিয়মিত মিটিং করি‌। 

বিআরটিএ অফিসে অবস্থান করা রাব্বি ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কর্মচারী আমিরুল ইসলামের কার্যকালাপের সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাব্বি আমাদের অফিসের কেউ না, সে এসে ওখানে বসে থাকে। আর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে চাকরি করে আমিরুল নামে একটি ছেলে মাঝে মধ্যেই অফিসে আসে দেখি। সে যদি কোনো অবৈধ কর্মকাণ্ড করে থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে।

এফএইচএম মঈদুর রহমান বলেন, আমি এই দুজন সম্পর্কে অফিসের সবাইকে অবগত করবো। তারা যাতে প্রভাব খাটিয়ে কিছু করতে না পারে। বিআরটিএ অফিসের কেউ দালালদের সহযোগিতা করে না বলেও তিনি জানান।

সেবাগ্রহীতাদের দুর্ভোগের বিষয়ে তিনি বলেন, অনেক কাজ অনলাইনে হওয়ার কারণে অনেক সময় সার্ভার ও ইন্টারনেটের সমস্যার কারণে বিলম্ব হয়ে থাকে। তবে ইচ্ছাকৃতভাবে যদি কেউ হয়রানি করে থাকে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক আবু নাছের ভূঁঞা ঢাকা পোস্টকে বলেন, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কোনো স্টাফ যদি প্রভাব খাটিয়ে বিআরটিএ অফিসে দালালি করে অবশ্যই তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এসব কর্মকাণ্ড প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। বিআরটিএ অফিসে দালালদের দৌরাত্ম বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

আরএআর