নিহত মনিরুল ইসলাম মমিন ও সাইফুল ইসলাম সুমন

বাড়িতে বিয়ের আমেজ, ছিল হই-হুল্লোড়। আত্মীয়-স্বজনও এসেছে। বিয়ের গেট, প্যান্ডেল, আলোক সজ্জাও হয়েছিল শেষ। একদিন আগে-পরে দুই ভাইয়ের বিয়ে। এক ভাইয়ের হলুদের অনুষ্ঠানও হয়েছিল শেষ। দুই ভাইয়ের বউভাত আগামীকাল শনিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) হওয়ার কথা ছিল। মুহূর্তের মধ্যে সব আনন্দ বিষাদে পরিণত হয়েছে। 

বুধবার (৩১ জানুয়ারি) দিবাগত রাত সোয়া ১২টার দিকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের খানখানাপুর এলাকায় মাটিবাহী ট্রাকচাপায় প্রাণ হারান দুই ভাই। এখন সেই বাড়িতে বউভাতের অনুষ্ঠানের পরিবর্তে চলছে কুলখানির আয়োজন।

নিহত দুই ভাই হলেন- রাজবাড়ী সদর উপজেলার খানখানাপুর ইউনিয়নের কদমতলী গ্রামের মোকছেদ আলী সরদারের ছেলে মনিরুল ইসলাম মমিন (৩২) ও সাইফুল ইসলাম সুমন (২৭)। পরিবারে মধ্যে মনিরুল বড় ও সুমন ছোট সন্তান। মনিরুল গাজীপুরে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। আর সুমন রাজবাড়ী যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে চাকরি করতেন। বৃহস্পতিবার (১ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে স্থানীয় কবরস্থানে তাদেরকে দাফন করা হয়।

জানা গেছে, কদমতলী গ্রামের মোকছেদ সরদারের মেজো ছেলে ও ছোট ছেলের বিয়ের দিন ছিল বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার। শনিবার তাদের বউভাত অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল একইসঙ্গে। ছোট দুই ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বড় ভাই মনিরুল ইসলাম মমিন গাজীপুর থেকে রওনা হয়েছিলেন। বুধবার রাত ১১টার দিকে হলুদের অনুষ্ঠান শেষে ছোট ভাই সুমন তাকে দৌলতদিয়া ঘাট থেকে আনতে যান মোটরসাইকেলে। কিন্তু ফেরার পথে রাত সোয়া ১২টার দিকে গোয়ালন্দ উপজেলার ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের মকবুলের দোকান এলাকায় ইট ভাটার মাটি বহন করা ড্রাম ট্রাকের চাপায় বড় ভাই মনিরুল ইসলাম মমিন ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন এবং ছোট ভাই সুমনকে গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্থানীয়রা নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকেও মৃত ঘোষণা করেন।

নিহতদের মেজো ভাই শামীউল ইসলাম শামীম জানান, রাজবাড়ী ড্রাই আইচ ফ্যাক্টরি এলাকায় পারিবারিকভাবে এক বছর আগে তার বিয়ে ঠিক হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার তার বরযাত্রী নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। রাজবাড়ী আলীপুর এলাকায় বিয়ে ঠিক হয় ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম সুমনের। আজ শুক্রবার তার বরযাত্রী যাওয়ার কথা ছিল। বুধবার রাতে দুই ভাইয়ের একত্রে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান হয়। শনিবার দুই ভাইয়ের বউভাতের অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল একসঙ্গে। দুই ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গাজীপুর থেকে রওনা হয়েছিলেন বড় ভাই মনিরুল ইসলাম মমিন। বড় ভাইকে দৌলতদিয়া ঘাট থেকে এগিয়ে আনতে মোটরসাইকেল নিয়ে যান ছোট ভাই সুমন। ফেরার পথে বাড়ির কাছে এসে ট্রাকচাপায় মৃত্যু হয় দুই ভাইয়ের। এখানেই আমাদের সব শেষ হয়ে গেল। বাড়ি ভর্তি আত্মীয়-স্বজন দাওয়াত খেতে এসেছে। এক নিমিষেই সৃষ্টিকর্তা আমাদের সব আনন্দ বিষাদে পরিণত করে দিল। এখন বিয়ে বাড়িতে দুই ভাইয়ের বউভাতের অনুষ্ঠানের পরিবর্তে কুলখানির আয়োজন চলছে ।

তিনি আরও বলেন, আমাদের বউভাতের আয়োজনো বাবা ৫০০ মানুষকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। এক সাথে দুই ভাইয়ের বিয়ে হওয়াতে বাড়ি ভর্তি মানুষসহ প্রতিবেশিরাও অনেক অনন্দিত ছিল। কিন্তু নিমিষেই সব আনন্দ বিষাদে পরিণত হয়েছে। 

শামীউল ইসলাম শামীম বলেন, এক বছর আগে বিয়ে হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে আমার বউকে তুলে আনা হয়নি। একসঙ্গে দুই ভাইয়ের বউভাত অনুষ্ঠান করে দুই বউ বাড়িতে আনার কথা ছিল। আমার বউ রাজবাড়ী সরকারি কলেজে প্রাণীবিদ্যা বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির ছাত্রী। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার সকালেই মায়ের সঙ্গে আমাদের বাড়িতে আসছে সে। 

নববধূ জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, বৃহস্পতিবার নববধূর সাজে আমার শ্বশুরবাড়ি আসার কথা ছিল। সড়ক দুর্ঘটনায় ভাশুর মনিরুল ও দেবর সাইফুলের মৃত্যুর সংবাদ শুনে মাকে নিয়ে আমি ছুটে এসেছি শ্বশুরবাড়িতে।

প্রতিবেশী বাচ্চু খাঁন বলেন, একসঙ্গে দুই ভাইয়ের মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। এই রকম হৃদয়বিদারক ঘটনা এর আগে আমাদের এলাকায় ঘটেনি। দুই ভাইয়ের যেখানে একসঙ্গে বউভাত অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল সেখানে এখন তাদের কুলখানির আয়োজন চলছে।

আহলাদিপুর হাইওয়ে থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) এম আল মামুদ বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে দুই ভাই নিহতের ঘটনায় আরেক ভাই শামীউল ইসলাম বাদী হয়ে ট্রাকচালক গোলজার হোসেনের বিরুদ্ধে গোয়ালন্দ ঘাট থানায় মামলা করেছেন। ঘটনার পর ট্রাকটি জব্দ করা হয়েছে। পলাতক ট্রাকচালককে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করা হচ্ছে।

মীর সামসুজ্জামান সৌরভ/আরএআর