ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার কাইচাইল ইউনিয়নের ঝাটুরদিয়া গ্রামের আজিজুল ইসলাম খানের স্ত্রী মনিরা বেগম (৪২)। গত বছর তার বাড়িতে এসে অলোক মন্ডল (৪৯) নামে এক ব্যক্তি নিজেকে মিডল্যান্ড এজেন্ট ব্যাংক ঝাটুরদিয়া শাখার কর্মকর্তা বলে পরিচয় দেন। এ সময় মনিরা বেগমকে বলেন, আমাদের ব্যাংকে টাকা জমা রাখলে মুনাফা পাবেন অন্য ব্যাংকের চেয়ে তিন শতাংশ বেশি। সঞ্চয়ী হিসাবে টাকা জমা রাখলে বছর শেষে অন্য যেকোনো ব্যাংকের চেয়ে লাভ বেশি পাবেন।

অলোক মন্ডলের লোভনীয় অফারের কথা শুনে তিনি ব্যাংকের সেই এজেন্ট শাখায় অ্যাকাউন্ট খুলে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা জমা রাখেন। এরপর হঠাৎ ২৫ জানুয়ারি তিনি জানতে পারেন তার অ্যাকাউন্টে রাখা ১ লাখ ২০ হাজার টাকা জমাই হয়নি। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, যে-সব কাগজের বিপরীতে তিনি টাকা জমা দিয়েছেন তার সবই জাল।

শুধু মনিরা বেগমই নয় ওই শাখার অন্তত ২৫ জন গ্রাহকের প্রায় ৫২ লাখ ৯৫ হাজার ৫০০ টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছেন শাখা ব্যবস্থাপক অলোক মন্ডল। তিনি ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার চান্দ্রা ইউনিয়নের চান্দ্রা গ্রামের বাসিন্দা। গত ২৬ ডিসেম্বর থেকে তালাবদ্ধ রয়েছে ব্যাংকটির সেই শাখা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৫ বছর আগে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পশ্চিম পাশে নগরকান্দার কাইচাইল ইউনিয়নের ঝাটুরদিয়া বাজারে একটি ভবন ভাড়া নিয়ে মিডল্যান্ড ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং শাখা খোলা হয়। সে সময় মিডল্যান্ড ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ও মালিগ্রাম শাখার কর্মকর্তারা এবং ঝাটুরদিয়া এজেন্ট ব্যাংকিং শাখার শাখা ব্যবস্থাপক অলোক মন্ডল উপস্থিত ছিলেন।

এজেন্ট ব্যাংকিং শাখা চালুর পর গত বছরের ২৬ ডিসেম্বরের পর থেকে ব্যাংকটির প্রধান গেটে দুটি তালা মারা। সামনে মিডল্যান্ড ব্যাংক লিমিটেড কর্তৃপক্ষ থেকে একটি ‘জরুরি বিজ্ঞপ্তির’ ব্যানার সাঁটিয়ে দেওয়া হয়। ব্যানারে ঝাটুরদিয়া এজেন্ট ব্যাংকিং শাখার সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়। 

ঝাটুরদিয়া এজেন্ট ব্যাংকিং শাখার কার্যক্রম বিস্তৃত রয়েছে নগরকান্দার কাইচাইল, চর শোরদী ও ভাঙ্গার আলগী ইউনিয়নের অন্তত পনেরোটি গ্রামে। এ ছাড়া পেঁয়াজের মৌসুমে পেঁয়াজ চাষি ও ব্যবসায়ীদের হাতের নাগালে ব্যাংকটি হওয়ায় সবাই ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে গ্রাহক হন। ব্যাংকের একজন কাস্টমার সার্ভিস প্রতিনিধি প্রতিদিন ওই এলাকার বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে মানুষকে অ্যাকাউন্ট খোলা, এফডিআর এ টাকা জমা রাখা, বিদেশ থেকে টাকা আনার ব্যাপারে  উদ্বুদ্ধ করতেন। এসব লেনদেনে অন্যান্য ব্যাংকের চেয়ে সুবিধা ও লভ্যাংশ বেশি দেওয়ার কথাও বলা হয়।

যে-সব গ্রাহক টাকা খুইয়েছেন, নগরকান্দার ঝাটুরদিয়ার বাসিন্দা ও ব্যাংক ভবনের মালিক শহীদ খান ৪ লাখ ৬৪ হাজার, দশ খারদিয়া গ্রামের জাহানারা বেগম ১ লাখ ২৩ হাজার, ঝাটুরদিয়ার মনিরা বেগম ১ লাখ ২০ হাজার, দশ খারদিয়া গ্রামের সিরাজুল ইসলাম ১২ লাখ, মেঘারকান্দি গ্রামের সুশেন মন্ডল ২ লাখ ৫০ হাজার, আলগী গ্রামের ননী গোপাল ২ লাখ ৯৫ হাজার ৫০০, একই গ্রামের হৃদয় কুমার বিশ্বাস ৪ লাখ, ঝাটুরদিয়ার আনোয়ারা বেগম ৩০ হাজার, একই গ্রামের মনির খান ১ লাখ ৫০ হাজার, আড়ুয়াকান্দীর সাত্তার মিয়া ২ লাখ, একই গ্রামের আবদুর রহমান ২ লাখ ৩০ হাজার, কাইচাইলের আইয়ুব মিয়া ১ লাখ ২৮ হাজার, নাগারদিয়া মসজিদ কমিটি ৭০ হাজার, সাদিপুরের শিউলি বেগম ১ লাখ, শুয়াদীর নাসরিন বেগম ৭০ হাজার, বড় কাজুলীর আলেয়া বেগম ১ লাখ ৮৫ হাজার, নোয়াকান্দার শাজাহান মাতুব্বর ৬ লাখ, একই গ্রামের কামাল মাতুব্বর ১ লাখ, ইমারত মিয়া ৫০ হাজার ও পানু রানী মন্ডল ৩০ হাজার টাকা। এ ছাড়া আরও কয়েকটি হিসেবের বিপরীতে ২৫ জন গ্রাহকের আরও ৫ লাখ টাকাসহ কমপক্ষে ৫২ লাখ ৯৫ হাজার ৫০০ টাকা নিয়ে উধাও হয়েছেন ব্যবস্থাপক অলোক মন্ডল।

নগরকান্দার চরযশোরদী ইউনিয়নের দশ খারদিয়া গ্রামের বাসিন্দা মো. সিরাজুল ইসলাম (৫৪) বলেন, আমি ওই ব্যাংকে অনেকদিন ধরে লেনদেন করছি। ওদের সেবায় আমি সন্তুষ্ট ছিলাম। এজন্য গতবছর ৬ বছর মেয়াদি আমানত হিসাবে ১২ লাখ টাকা জমা রাখি। আমার সব কাগজও রয়েছে। তবে এখন মালিগ্রাম শাখায় গিয়ে শুনি আমার নামে কোনো এফডিআর হিসেব খোলা হয়নি।

ভাঙ্গার আলগী ইউনিয়নের নিধিরামপুর গ্রামের বাসিন্দা ননী গোপাল (৩২) বলেন, এই ব্যাংকে আমার সঞ্চয়ী হিসাবে আমি ২ লাখ ৯৫ হাজার ৫০০ টাকা জমা করেছি। এখন শুনি এসবের একটা টাকাও আমার হিসাবে জমা হয় নাই।

একই গ্রামের হৃদয় কুমার বিশ্বাস (৩৩) বলেন, আমার সঞ্চয়ী হিসাবে ৪ লাখ টাকা জমা করেছি। এখন শাখা ব্যাংক থেকে আমাকে বলছে তোমার হিসাবে কোনো টাকা নাই। আমার কাছে টাকা জমার রসিদ এমনকি মোবাইলে কোনো ম্যাসেজও আসেনি। এসব ব্যাপারে ম্যানেজারকে বললে তিনি সার্ভারে সমস্যার কথা বলতেন। 

এলাকার ভুক্তভোগী গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই শাখার ব্যবস্থাপক ছিলেন অলোক মন্ডল। এসব কাজে তার সহযোগীরাও তাকে সাহায্য করেছেন। অলোক ছাড়াও ওই শাখায় আরও চারজন কর্মকর্তা কর্মরত ছিলেন। তারা হলেন ক্যাশিয়ার ঝাটুরদিয়া গ্রামের সাধনা হাওলাদার ও মাগুরার রত্না রানী, কম্পিউটার অপারেটর রাজবাড়ী সদরের জাহাঙ্গীর শেখ এবং মাঠকর্মী কাম কাস্টমার সার্ভিস প্রতিনিধি ভাঙ্গার নোয়াকান্দা গ্রামের মিঠুন মাতুব্বর।

ব্যাংক ভবনের মালিক ঝাটুরদিয়া গ্রামের শহীদ খান বলেন, আমার ৪ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ছিল। এ ছাড়া ভাড়া বাবদ তাদের কাছে ২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা পাব। এই টাকা এখন আমাকে কে দেবে? মালিগ্রাম শাখায় গিয়ে ভাড়া ও সঞ্চয়পত্রের কাগজপত্র দেখিয়েছি। তারা বলে ভাড়ার ব্যাপার আমরা জানি না আর সঞ্চয়পত্রের কাগজ ভুয়া।

এ ব্যাপারে অলোক মন্ডলের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তার বাড়িতে গেলেও তাকে পাওয়া যায়নি। 

তবে কথা হয় ওই শাখার মাঠকর্মী কাম কাস্টমার সার্ভিস প্রতিনিধি ভাঙ্গার নোয়াকান্দা গ্রামের মিঠুন মাতুব্বরের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদেরকে কাছে পেয়ে সবাই আমাদের দোষারোপ করছেন। আমরা অল্প বেতনে চাকরি করছি। আমরা তো আর এত কিছু জানি না। টাকা পয়সা সব থাকত ম্যানেজার অলোকের কাছে। আমরা শুধু আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি। 

ঝাটুরদিয়া এজেন্ট ব্যাংকিং শাখার সমন্বয়ক ভাঙ্গার মালিগ্রাম শাখার ব্যবস্থাপক মো.আসিফ ইকবাল বলেন, এ সংক্রান্ত অভিযোগ নিয়ে আমাদের কাছে কয়েকজন এসেছিল। তাদের হিসাব চেক করে দেখা গেছে, তাদের হিসাবে কোনো টাকাই জমা হয়নি। তারা প্রমাণস্বরূপ যে-সব কাগজ দেখাচ্ছেন তার সব ভুয়া। ওই শাখার ব্যবস্থাপক এসব কাজ করতে পারেন।

তিনি আরও বলেন, এই যুগে এসেও একজন মানুষ টাকা জমা রাখছেন আর তার মোবাইলে কোনো মেসেজ যাচ্ছে না এটা নিয়ে তারা অভিযোগ করছেন না। তাছাড়া আমাদের এজেন্ট ব্যাংকিং শাখায় প্রতিটা লেনদেনের ক্ষেত্রে হাতের ছাপ নেওয়া হয়। এদের ক্ষেত্রে হাতের ছাপ নেওয়ারও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

তিনি আরও বলেন, ওই এলাকার মানুষের সঙ্গে অলোক এমন একটা সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন যাতে মানুষ তার প্রতি কোনো সন্দেহ না করে। অলোককে সবাই অন্ধের মত বিশ্বাস করেছে। আমি এ বিষয়ে অভিযোগ পাওয়ার পর হেড অফিসে জানিয়েছি। আমাদের এজেন্ট ব্যাংকিং বিভাগ বিষয়টা নিয়ে কাজ করছে।

এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে নগরকান্দা থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমিনুর রহমান বলেন, গত ১০ থেকে ১২ দিন আগে এ সংক্রান্ত একটি অভিযোগ পেয়েছি। যেহেতু এটা প্রযুক্তিগত বিষয় তাই আমরা আমাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতাসম্পন্ন ইউনিটের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছি। আশা করি, খুব দ্রুতই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হব।

প্রসঙ্গত, মিডল্যান্ড ব্যাংক লিমিটেড ২০১৩ সালের ২০ মার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দ্বায়িত্ব পালন করছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহর স্ত্রী নিলুফার জাফরুল্লাহ। ব্যাংকটির পরিচালক পদে রয়েছে কাজী জাফরউল্যাহর ছেলে কাজী রায়হান জাফর। কাজী জাফরউল্যাহ নিজেও ব্যাংকটির একজন শেয়ার হোল্ডার। তবে সেখানে তার পরিচয় রাজনীতিবিদ নয়। সেখানে তাকে পরিচয় দেওয়া হয়েছে দেশের একজন ব্যবসায়ী হিসেবে।

জহির হোসেন/এএএ