গরু নয়, তেলের ঘানি টানছে অটোরিকশা
দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। ব্যস্ততম সড়কের পাশে বিরামহীনভাবে ঘুরছে একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। চালকের আসন ফাঁকা। কাছে গিয়ে দেখা গেল এটি সরিষার তেল উৎপাদনের ঘানি। সরিষার তেল তৈরিতে এতোদিন কলুর বলদের চল থাকলেও সেই ঘানি টানছে একটি অটোরিকশা।
গরু ছাড়া অটোরিকশা দিয়ে এমন ঘানি টানার দৃশ্য চোখে পড়বে রাজশাহী পুঠিয়া উপজেলার শিবপুর বাজারে। সরিষার তেলের ঘানিটি রাজশাহী-নাটোর মহাসড়কের পাশে। এমন অভিনব উপায়ে তেল উৎপাদন করছেন পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর ইউনিয়নের নামাজগ্রামের বাসিন্দা টিপু। তার অনুপস্থিতিতে ঘানি দেখাশোনা করেন আনারুল ইসলাম।
বিজ্ঞাপন
টিপু বলেন, মোবাইলে প্রথম তেলের ঘানি দেখেছিলাম। এরপর যোগাযোগ করে রংপুরে যাই। সেখানে সরিষার তেল উৎপাদনের ঘানি দেখে মিস্ত্রি নিয়ে এসে তেলের ঘানি তৈরি করি। তারা ঘানিতে বলদ ব্যবহারের কথা বলেছিল। মিস্ত্রিদের জিজ্ঞাসা করি। তারা বলে, ঘানি বিদ্যুতেও ঘোরাতে পারি আবার অন্য কোনো উপায়েও ঘোরাতে পারি। এরপরই মাথায় আসলো অল্প খরচে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার বিষয়টি। তারপরে বলদের পরিবর্তে অটোরিকশা লাগাই।
তিনি আরও বলেন, এই ঘানি তৈরিতে প্রায় তিন লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এখানেই সারাদিন চলে আবার সারারাত চার্জ হয়। একটা গরুর সারাদিন এইভাবে ঘোরা সম্ভব না। তাহলে দুইটা গরু কিনতে হবে। দুইটা গরু দেখভালের জন্য একটা মানুষ প্রয়োজন। তার আবার বেতন দিতে হবে। সবমিলে তেল তৈরির খরচ বেড়ে যাবে। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এসে দেখে বলে, ঠিক বুদ্ধি হয়েছে। গরু জানে বেঁচেছে।
আনারুল ইসলাম বলেন, দুই বছর আগে কাঠের তৈরি সরিষা তেলের ঘানি করা হয়। কাঠের তৈরি ঘানির কারণে এর রঙ, স্বাদ ও ঘ্রাণ ঠিক থাকে। সরিষা ঘানিতে দেওয়ার তিন ঘণ্টা পরে তেল বের হতে শুরু হয়। ১০ কেজি সরিষা থেকে তেল বের হয় ৩ থেকে সোয়া ৩ লিটার। আর এক মণ সরিষা ঘানিতে ভাঙলে তেল হয় ১২ থেকে ১৩ লিটার। তেলের চাহিদা ব্যাপক। দূর-দূরান্ত থেকে সরাসরি ও অনলাইনে অনেকেই কিনে নিয়ে যায়। আমাদের সরিষার এক নম্বর খাঁটি তেল এগুলো।
তিনি বলেন, সরিষাগুলো বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগ্রহ করা হয়। সবচেয়ে বেশি চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর, গোদাগাড়ীর কাঁকনহাট ও তানোরের মুণ্ডুমালা হাট থেকে। এইসব হাটগুলোতে কৃষকের থেকে ভালো সরিষা কিনতে পাওয়া যায়। হাটগুলোতে কয়েক ধরনের সরিষা পাওয়া যায়। যেহেতু তেলের সুনামের বিষয় জড়িত তাই আমরা ভালো সরিষাই কিনে থাকি। ঘানিতে দুই ধরনের সরিষা দেওয়া হয়- যেমন দানা মোটা ও অপরটি ভালো সরিষা। এখানে শুধু সরিষার তেলই বিক্রি করা হয় না- বিক্রি হয় সরিষার খৈলও।
সরিষার তেল বিক্রির বিষয়ে আনারুল ইসলাম বলেন, অনলাইনে ঢাকা রংপুর, পাবনা, নাটোরের মানুষ কিনে থাকে। তার মধ্যে সরাসরি বেশি তেল কিনে থাকে অনেকেই। সরিষার এক নম্বর খাটি তেল বিক্রি করা হয়। এই তেল নিতে ক্রেতাদের খুব চাপ। বেশির ভাগ সরাসরি এখান থেকে তেল কিনে নিয়ে যায়। কোন দোকান বা আলাদা করে তেল বিক্রি করা হয় না। এখান থেকেই বিক্রি হয়ে যায়।
নাটোরের আহম্মেদপুর থেকে সরিষার তেল কিনতে আসা রাকিবুল ইসলাম ও সাইফুল ইসলাম। তারা বলেন, এই ঘানির তেলের রঙ, স্বাদ ও ঘ্রাণ ভালো। তাই চাহিদাও বেশি, দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই আসেন কিনতে। দোকানে ১৯০ টাকা লিটার হলে টিপুর ঘানিতে ২১০ টাকা লিটার। এখানকার তেলে কোন ধরনের ভেজাল দেয় না। মানুষের আস্তা আছে টিপুর প্রতি।
বানেশ্বর থেকে গরুর খামার হাসান আলী কিনতে এসেছেন তেল ও খৈল। তিনি বলেন, এখানে খাঁটি সরিষার তেল পাওয়া যায়। তেল বাড়ির জন্য নিলাম। আর খৈল গরুকে খাওয়ানোর জন্য নিলাম। দীর্ঘদিন থেকে এইভাবে সরিষার তেল তৈরি করে বিক্রি করছে টিপু। প্রথম অবস্থায় তেমন ভালো না চললেও এখন ভালো বিক্রি হয়।
টিপুর দাবি কাঠের ঘানির ফলে তেলে গুনাগুণ নষ্ট হয় না। আর লোহার তৈরি ঘানিতে লোহার ঘর্ষণে তেলটা পুড়ে যায়। ফলে তেলের গুনাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। কাঠের তৈরি ঘানিতে তেল পুড়ে যায় না। এই কারণে দাম বেশি হলেও চাহিদা বেশি।
শাহিনুল আশিক/আরকে