আলেয়া বেগম

শিশুকে পৃথিবীর আলো দেখাতে মা-বাবার পর যার ভূমিকা থাকে তিনি হলেন ধাত্রী। বর্তমান বিশ্বে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশু জন্মের হার বাড়লেও গর্ভবতী মায়েদের পছন্দ স্বাভাবিক প্রসব (নরমাল ডেলিভারি)। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানও মা ও শিশুর জীবন সংকট না হলে এই প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করে বিশ্বব্যাপী পালন করে আন্তর্জাতিক ধাত্রী দিবস। 

স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় গর্ভবতী মায়েদের সন্তান প্রসবে সহযোগিতা করায় ধাত্রী হিসেবে পরিচিত শরীয়তপুরের আলেয়া বেগম। হাজারেরও অধিক গর্ভবতী মায়ের সন্তান প্রসবে সহযোগিতা করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। তাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান প্রসবে মায়েদের ভরসা আলেয়া ধাত্রী।

সত্তর বছর বয়সী আলেয়া বেগম শরীয়তপুর সদর উপজেলার পালং উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকার আব্দুর রশিদ শেখের স্ত্রী। পেশায় তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত আয়া। তবে নিজ এলাকাসহ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ তাকে ধাত্রী হিসেবেই বেশি চেনে। 

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এক সময় হাসপাতালে আয়ার চাকরি করতেন আলেয়া বেগম। সেখানে গর্ভবতী মায়েদের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান প্রসবের সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করার জন্য চিকিৎসক ও সেবিকাদের কাছাকাছি থাকার সুযোগ হয়েছিল তার। চিকিৎসক ও সেবিকাদের কৌশল দেখে দেখে নিজেই রপ্ত করেন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান প্রসব করানোর খুঁটিনাটি। পরবর্তীতে গ্রামের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ধাত্রীদের সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন তিনি। এরপর একদিন আলেয়ার ডাক পড়ে বুড়িরহাট দেওভোগ গ্রামের খুকুমনির প্রসব বেদনার সময়। আলেয়া সফলতার সঙ্গে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান প্রসব করতে খুকুমনিকে সহযোগিতা করেন। ছেলে সন্তান জন্ম নেওয়ায় খুকুমনির বাবা রমিজ সরদার নানা হওয়ার আনন্দে আলেয়াকে হালকা গোলাপী রঙের একটি শাড়ি উপহার দিয়েছিলেন। 

আলেয়া ধাত্রীর সহযোগিতায় খুকুমনির সন্তান প্রসবের আনন্দের সংবাদটি প্রায় ২০ থেকে ২৫ বছর আগের। এরপর দীর্ঘ এই সময়ে আলেয়া ধাত্রী এক হাজারেরও অধিক গর্ভবতী মায়ের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান প্রসবে প্রধান সহযোগীর ভূমিকা রেখেছেন। একদিনে সর্বোচ্চ চারজন নবজাতকও তিনি প্রসব করিয়েছেন। এর মধ্যে কখনো কোনো মা বা নবজাতকের কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ক্ষয়ক্ষতি না হওয়ার কারণেই শরীয়তপুরের বিভিন্ন অঞ্চলের সন্তান সম্ভাবা গর্ভবতী মায়েদের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান প্রসবে ভরসা আলেয়া ধাত্রী। নবজাতকের জন্মের পর আর্থিক সচ্ছলতা অনুযায়ী আলেয়া ধাত্রীকে সম্মানি দেন নবজাতকের স্বজনরা। যে যা উপহার দেন তাতেই খুশি থাকেন আলেয়া। 

খাদিজা বেগম রায়হান ও রাফিজার মা। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় দুই সন্তান প্রসবেই তিনি আলেয়া ধাত্রীর সহযোগিতা নিয়েছেন। খাদিজা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রত্যেক নারীর জীবনের পূর্ণতা আসে মা হওয়ার মাধ্যমে। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান প্রসব করতে পারা আল্লাহর রহমত। রায়হান ও রাফিজা গর্ভে আসার পর চিকিৎসক আমাকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে প্রাধান্য দিতে উৎসাহিত করেছেন। পরবর্তীতে আমার দাদির থেকে খবর পেলাম আলেয়া ধাত্রীর। প্রথম সন্তান প্রসবের সময় আমার একটু ভয়ই লাগছিল। তবে আলেয়া ধাত্রীর নিপুণ কৌশলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আমার রায়হান পৃথিবীর আলো দেখেছে। আমার সন্তানরা যেমন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সুস্থ ও সুন্দরভাবে এসেছে। তেমনিভাবে পৃথিবীর সকল সন্তান জন্ম নিক, একজন মা হিসেবে আমার এই দোয়া থাকবে।

সুরাইয়া ইসলাম তমা নামে আরেকজন মা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আলেয়া ধাত্রীর সহযোগিতায় স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আমি পিয়ালের মা হয়েছি। আমার কষ্টের কথা ভেবে পিয়ালের জন্মের আগে ওর বাবা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেওয়ার কথা বললেও আমি রাজি হইনি। আল্লাহর রহমতে সন্তান প্রসবের পর আমি ও আমার সন্তান সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলাম। আলেয়া ধাত্রীর জন্য দোয়া করি, তিনি যেন অনেক দিন বাঁচেন।

আলেয়া ধাত্রী ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রথম দিকে যখন সন্তানসম্ভাবা মায়েদের সন্তান প্রসবে সহযোগিতা করতাম, তখন অনেকেই অনেক নানা কথা বলতো। কিন্তু আমার কখনো খারাপ লাগেনি। নতুন শিশু পৃথিবীতে আসবে, এর চেয়ে আনন্দের সংবাদ মানুষের জীবনে আর কিছু নেই। আর সেই সন্তান স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় প্রসব করতে এক হাজারের বেশি মাকে সহযোগিতা করেছি আমি। এটা আমার জন্যে গর্বের। প্রথম দিকে গুণে রেখেছিলাম, পরবর্তীতে ব্যস্ততার কারণে আর গণণা করা সম্ভব হয়নি। জন্মের পর শিশুর চিৎকার ও মাকে খোঁজার দৃশ্য আমার অনেক পছন্দের। আমার হাতের ওপর জন্ম নেওয়া অনেক শিশু এখন পড়াশোনা শেষ করে বড় অফিসারও হয়তো হয়েছে।

শরীয়তপুর পৌরসভার প্যানেল মেয়র বিল্লাল হোসেন খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আলেয়া বেগমকে অনেক আগে থেকেই চিনি আমি। তিনি ধাত্রী হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। নিজ গ্রামসহ অন্যান্য গ্রামে গিয়েও তিনি সেবা দিয়ে থাকেন। হাজারের অধিক মায়ের সন্তান প্রসবে ধাত্রী হিসেবে সেবা করায় তাকে আমি অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাই।

শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. রোকসানা বিনতে আকবর ঢাকা পোস্টকে বলেন, আলেয়া বেগম পেশায় একজন আয়া। কিন্তু অনেক আগে থেকে উনি ধাত্রীর কাজ করেন। গ্রামের অন্য অভিজ্ঞদের কাছ থেকে কাজটি রপ্ত করলেও উনার উচিত ছিল প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার। প্রশিক্ষণ গ্রহণ না করেও সুন্দরভাবে হাজারেরও অধিক সন্তান প্রসব হয়েছে উনার সহযোগিতায়। উনার এই সহযোগিতাকে অবশ্যই আমি সাধুবাদ জানাবো। এক জীবনে হাজারের বেশি সন্তান প্রসবে ধাত্রী হিসেবে কাজ করায় আলেয়াকে আমি শুভেচ্ছা জানাই।

সাইফ রুদাদ/আরএআর