দীর্ঘদিন ধরে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের রাজধানীর সঙ্গে যাতায়াতের অন্যতম প্রধান নৌরুট ছিল দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া। পদ্মাসেতু হওয়ার পর এখানে চাপ কমে গেছে অর্ধেকের বেশি। এখন মানুষ যায় কম, পণ্যবাহী যান যায় বেশি। তারপরও কাছের জেলাগুলোর জন্য এখনো এই রুটের গুরুত্ব অনেক।

তবে কর্তৃপক্ষের কাছে যেন এর কোনো গুরুত্ব আর নেই। দিন দিন এই রুটের ব্যবস্থাপনায় অবহেলা স্পষ্ট হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে কয়েকদিন আগে ফেরিডুবির মতো ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগ উঠেছে, ডুবে যাওয়া ফেরিটি খুব পুরোনো ছিল এবং এটির ফিটনেসও ঠিক ছিল না। অর্থাৎ ফেরিটি চলাচলের উপযোগী ছিল না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই নৌরুটে চলাচলকারী বেশিরভাগ ফেরিই ফিটনেসবিহীন এবং পুরোনো। শীতের সময় কুয়াশার মধ্যে ফেরি চলাচলের সুবিধার জন্য পাঁচ কোটি টাকা খরচ করে যেসব ফগ লাইট বসানো হয়েছিল সেগুলোও বিকল হয়ে পড়ে আছে।

গত সপ্তাহের বুধবার সকালে কুয়াশায় আটকে থাকা ছোট ইউটিলিটি ফেরি ‘রজনীগন্ধা’র তলা ফেটে গিয়ে পানি ওঠা শুরু করে। এক পর্যায়ে ৯টি ট্রাক নিয়ে সেটি ডুবে যায়। ডুবে যাওয়া ফেরিটির ফিটনেস ছিল না বলে ফেরিতে থাকা ট্রাক চালক ও হেলপাররা অভিযোগ করেছেন।

এর আগে, ২০২১ সালের ২৭ অক্টোবর ‘আমানত শাহ’ নামের একটি ফেরি ১৭টি যানবাহন নিয়ে পাটুরিয়ার ৫ নম্বর ফেরি ঘাটের কাছে ডুবে যায়। সেই ফেরিও ফিটনেসবিহীন ছিল। ফেরিটি প্রায় ৪১ বছরের পুরোনো ছিল। এটির কোনো সার্ভে সার্টিফিকেট ছিল না।

৫৩ ফেরির মধ্যে ৪৭টিরই সনদ নেই

জানা গেছে, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটের অধিকাংশ ফেরির বয়স ৩৫ বছরের বেশি। রজনীগন্ধার বয়স ছিল ৪৭ বছরের বেশি। রো রো ফেরি ‘খান জাহান আলী’ তৈরি হয় ১৯৮৭ সালে। আরেক রোরো ফেরি ‘কেরামত আলী’ ৩৬ বছরের পুরোনো। ‘বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর’ ফেরি তৈরি হয় ১৯৯২ সালে।

বিআইডব্লিউটিসির একটি সূত্রে জানা গেছে, তাদের আওতাধীন ৫৩টি ফেরির মধ্যে ৪৭টিরই সনদ নেই। এসব ফেরির বেশিরভাগ ৪০ বছরের বেশি পুরাতন। এছাড়া ১৮টি রো রো ফেরির (বড় ফেরি) মধ্যে ১৪টিরই ফিটনেস সনদ নেই। নেই বেশিরভাগ ফেরিতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জামাদিও। অনেক ফেরির বয়স ৪০ বছর পার হয়ে গেছে। আইন অনুযায়ী ৪০ বছরের বেশি বয়সী নৌযানের ফিটনেস সনদ দেয় না বাংলাদেশ নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর। তারপরও চলছে ফেরি সার্ভিস। ঘটছে দুর্ঘটনা।

‘অকাজের কাজি’ ৫ কোটি টাকার ফগ লাইট

বিআইডব্লিউটিসির আরিচা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০টি ফেরিতে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ফগ লাইট বসানো হয়। একেকটি ৭ হাজার কিলোওয়াটের লাইট কিনতে ৫০ লাখ টাকার বেশি ব্যয় হয়। বলা হয়েছিল, এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। অথচ কয়েক দিন পরই অধিকাংশ লাইট নষ্ট হয়ে যায়। ‘খান জাহান আলী’, ‘শাহ আলী’, ‘কেরামত আলী’, ‘ভাষা শহীদ বরকত’, ‘কপোতি’, ‘বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমীন’, ‘বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর’, ‘শাহ আমানত’ ও ‘শাহ পরান’ ফেরিতে ফগ অ্যান্ড সার্চ লাইট বসানো হয়। দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুটে ছোট-বড় ১৬টি ফেরি চলাচল করে। এসব ফেরিতে ১৭ থেকে ১৮শ যানবাহন পারাপার হয়। কিন্তু কুয়াশার কারণে প্রতিদিনই তিন থেকে ৯ ঘণ্টা পর্যন্ত ফেরি চলাচল বন্ধ থাকছে।

কয়েকজন ফেরিচালক জানান, প্রতিটি ফেরির বয়স ৩৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। নাব্যতা সংকটের কারণে ধীরে ধীরে চললেও কুয়াশার কারণে প্রতিদিনই ৬ থেকে ৯ ঘণ্টা ফেরি বন্ধ রাখতে হয়। ফগ লাইট লাগানো হলেও তা কাজে আসেনি। নদীপথ অস্পষ্ট হয়ে গেলেই ফেরি বন্ধ করে দেয় ঘাট কর্তৃপক্ষ। অথচ কোটি টাকা খরচ করে এই কুয়াশার কারণে ফেরিতে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ফগ লাইট লাগানো হয়েছিলো যা কোনো কাজেই আসছে না।

রজনীগন্ধার কী হয়েছিল?

দুর্ঘটনার দিন রজনীগন্ধার আরোহী ছিলেন ট্রাকচালক আশিক। তিনি বলেন, ফেরিটির কোনো নৌযানের সঙ্গে ধাক্কা লাগেনি। তলা দিয়ে পানি ঢুকে কাত হয়ে ডুবে যায়। ফেরিটি অনেক পুরাতন ও ফিটনেসবিহীন ছিল। কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণেই এটি ডুবে যায়।

রজনীগন্ধা ফেরি ডুবির প্রত্যক্ষদর্শী আরেক ট্রাক চালক মজনু বলেন, রাতে দৌলতদিয়া থেকে রওনা হওয়ার পর মাঝ নদীতে এসে কুয়াশার কারণে ফেরি নোঙর করে রাখা হয়। পরে ভোর সাড়ে ৪টার দিকে ফেরিতে পানি উঠতে থাকে। এ সময় ফেরির লোকজন পানি নিষ্কাশন করার চেষ্টা করলেও ধীরে ধীরে ফেরিটির এক পাশ কাত হয়ে ডুবতে থাকে। একপর্যায়ে সকাল সোয়া ৮টার দিকে সব মালবাহী ট্রাক নিয়ে ফেরিটি পানিতে তলিয়ে যায়। এ সময় আমরা যে যার মতো জীবন বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে তীরে উঠি। ফেরিটির সঙ্গে কোনো বাল্কহেডের ধাক্কা লাগেনি।

ফেরিগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ- এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন করপোরেশন। বিআইডব্লিউটিসির আরিচা কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) শাহ মোহাম্মদ খালেদ নেওয়াজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ নৌপথে মেয়াদোত্তীর্ণ কোনো ফেরি নেই। ফেরি রজনীগন্ধার কাগজপত্র সব ঠিক ছিল, ফিটনেস ছিল, সার্ভে ছিল। অনেকেই বলছে ফিটনেস ছিল না। তারা এটা না জেনে বলেছে। দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে ৯টি রো রো ফেরি, ৩টি ইউটিলিটি ফেরি, ১টি কে টাইপ ফেরি ও ৩টি ছোট ফেরি রয়েছে। প্রত্যেকটি ফেরির ফিটনেস ও কাগজপত্র ঠিক রয়েছে।

বাল্কহেডের ধাক্কায় ফেরিটি ডুবেছিল কি না? জবাবে তিনি বলেন, অনেকে অনেক কথা বলেছে। ঘটনাস্থলে কেউ ছিল না। বিভিন্ন কথার পরিপেক্ষিতে এগুলো আলোচনায় আসছে। যেহেতু এখন তদন্ত কমিটির মাধ্যমে তদন্ত চলছে সেহেতু আমরা প্রকৃত কারণ জানতে পারব। অনেকেই বলেছেন প্রচণ্ড শব্দ হয়েছে, ট্রলার অথবা বাল্কহেডের ধাক্কা লেগে ডুবেছে। এগুলো তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থিত অথবা আশপাশের লোকের বা স্থানীয়দের কথা ছিল। ঘটনা যখন ঘটে তখন আমিও অন দ্যা স্পটে ছিলাম না। লোকাল লোকদের ও জেলেদের কথার ভিত্তিতে ধারণা করা হয়েছিল কোনো কিছুর সঙ্গে ধাক্কা লেগে ডুবেছে। তদন্ত প্রতিবেদন আসলে মূল কারণ জানা যাবে।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোস্তফা কামাল এ প্রসঙ্গে বলেন, পাঁচ বছরে একবার ফেরির ডকিং করতে হয়। রজনীগন্ধার ২০২১ সালে ডকিং হয়। আর ফগ লাইটের বিষয়ে মন্ত্রী কথা বলেছেন, আমি কিছু বলব না। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের পর ফেরিডুবির কারণ সম্পর্কে বলা যাবে।

ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান ড. এ. কে. এম মতিউর রহমান বলেছেন, ফেরির ফিটনেস ও দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখা হবে।

এদিকে ডুবে যাওয়া ফেরি রজনীগন্ধা এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সেখানে থাকা সব ট্রাকও উদ্ধার হয়নি।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) উপপরিচালক মো. শাহজাহান বলেন, এখন পর্যন্ত তিনটি যানবাহন উদ্ধার করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয় এসেছে। উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা, রুস্তম ও প্রত্যয়ের সমন্বয়ে ফেরিটিকে উদ্ধার করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

রজনীগন্ধার দ্বিতীয় মাস্টার (চালক) হুমায়ুন কবিরের সন্ধানও এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। হুমায়ুন কবিরের বাড়ি পিরোজপুরে। তিনি বিআইডব্লিউটিসি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের আরিচা আঞ্চলিক কমিটির দক্ষিণ (পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া) শাখার সভাপতি।

এমএ/জেএস