ফেরিডুবি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য, খোঁজ মেলেনি সেকেন্ড মাস্টারের
মানিকগঞ্জের পাটুরিয়ায় যানবাহন নিয়ে ফেরিডুবির ঘটনার ১২ ঘণ্টা পেরুলেও এখনো খোঁজ মেলেনি ফেরির সেকেন্ড মাস্টার হুমায়ুন কবিরের। ফেরিডুবির কারণ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্পোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) দাবি, বালুবাহী বাল্কহেডের ধাক্কায় নৌঙর করা ফেরিটি ডুবে গেছে। অন্যদিকে নৌ পুলিশ জানিয়েছে, নদীতে ডুবোচরে ধাক্কা খেয়ে ফেরির তলা ফেটে গিয়ে এ ঘটনা ঘটেছে। আর ফেরিতে থাকা প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ফেরির তলা দিয়ে পানি উঠে কাত হয়ে ধীরে ধীরে ফেরিটি যানবাহন নিয়ে তলিয়ে যায়।
বিজ্ঞাপন
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সূত্রে জানা গেছে, গতাকাল মঙ্গলবার (১৬ জানুয়ারি) রাত দেড়টার দিকে রাজবাড়ির দৌলতদিয়া ফেরিঘাট থেকে সাতটি ট্রাক ও দুটি কাভার্ডভ্যানসহ মোট নয়টি যানবাহন নিয়ে পাটুরিয়া ফেরিঘাটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে ফেরি রজনীগন্ধা। নদীতে ঘন কুয়াশার কারণে পাটুরিয়া ফেরিঘাটের ৫ নং ঘাটের পন্টুনের অদূরে পদ্মা নদীতে ফেরিটি নোঙর করা হয়। এ সময় পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে ফেরি চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ রাখে ঘাট কর্তৃপক্ষ। পরদিন সকাল সাড়ে ৭টার দিকে ফেরির মাস্টার ফেরিতে থাকা সকল যানবাহনের চালক ও সহযোগীদের দ্রুত উঠতে বলেন এবং ফেরিটি পন্টুনে নিয়ে আসার জন্য ইঞ্জিন চালু করেন। তবে এর আগেই ফেরিতে পানি উঠেতে শুরু করে বলে জানান ট্রাক চালকরা। এরপর সকাল সোয়া ৮টার দিকে ফেরিটি ধীরে ধীরে যানবাহন নিয়ে ডুবে যায়। এ সময় জীবন বাঁচাতে ফেরিতে থাকা যানবাহনের চালক, সহকারী ও ফেরিতে কর্মরত লোকজন নদীতে দ্রুত ঝাঁপ দেন। জীবন বাঁচাতে প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে তীরে ওঠেন তারা।
এ ঘটনার খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় প্রশাসনের লোকজন ট্রলার নিয়ে ঘটনাস্থলে যান। ঘটনাস্থল থেকে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ছয়জনকে উদ্ধার করে তীরে নিয়ে আসেন। এর মধ্যেই ফেরিটি নয়টি যানবাহন নিয়ে পানিতে তলিয়ে যায়।
ফেরিডুবির ঘটনার পর পাটুরিয়া ফেরিঘাট পরিদর্শনে আসেন মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক রেহেনা আকতার, বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান, নৌপরিবনহন সচিব, ফরিদপুর অঞ্চলের নৌপুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।
নৌপুলিশ জানায়, ফেরিডুবির ঘটনায় এখনো ফেরির সেকেন্ড ইঞ্জিন চালক হুমায়ুন কবির নিখোঁজ রয়েছেন। তবে ফেরিতে থাকা ২০ জন ব্যক্তিকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে অধিকাংশই মালবাহী ট্রাকের শ্রমিক। বিআইডব্লিউটিএ’র উদ্ধারকারী জাহাজ হামজার মাধ্যমে রাত ৮টা পর্যন্ত দুটি ট্রাক উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
ফেরিডুবির ঘটনার কারণ নিয়ে কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন। তাদের এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যে তিন ধরণের ভাষ্য উঠে এসেছে।
বিআইডব্লিউটিসির আরিচা কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক(বাণিজ্য) শাহ মোহাম্মদ খালেদ নেওয়াজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে ঘন কুয়াশার কারণে মাঝে মধ্যে ফেরি চলাচল বন্ধ রাখা হয়। গতকাল রাতেও ঘন কুয়াশার কারণে রজনীগন্ধা নামের ফেরিটি নদীতে নোঙর করা ছিল। পরে সকাল ৮টার দিকে জানতে পারি বালুবাহী একটি বাল্কহেডে সজোরে ধাক্কায় ফেরির একপাশ কাত হয়ে নদীতে ডুবে যায়। নদীতে ঘন কুয়াশার থাকার কারণে বাল্কহেডটি শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। ফেরিটিতে সাতটি ছোট ট্রাক ও দুটি বড় ট্রাক লোড দিয়ে আসে। এ ঘটনায় ফেরিতে থাকা যানবাহনগুলোর চালক, সহকারী এবং ফেরির স্টাফসহ ২০ জনকে উদ্ধার করা গেলেও ফেরির সেকেন্ড ইঞ্জিন চালক হুমায়ুন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।
এদিকে ফেরিডুবির করণ হিসেবে নৌপুলিশের ফরিদপুর অঞ্চলের পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফেরিটি নয়টি যানবাহন নিয়ে দৌলতদিয়া থেকে পাটুরিয়া ঘাটে আসার পথে ডুবোচরে ধাক্কা লাগে বলে জানান ফেরিতে থাকা ট্রাক চালকরা। এতে ফেরির নিচের অংশে ফুটো হয় এবং ফেরিতে পানি প্রবেশ করতে শুরু করে। নদীতে ঘন কুয়াশা থাকায় পথ দেখতে না পেয়ে পাটুরিয়া ঘাটের প্রায় ২৫০ ফুট অদূরে ফেরির মাস্টার ফেরিটি নোঙর করে। প্রাায় ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট সময় ধরে ফেরিটি ধীরে ধীরে নদীর পানিতে তলিয়ে যায়। তবে ফেরিটিতে ওভারলোড যানবাহন ছিল। এ ঘটনায় ফেরির দ্বিতীয় ইঞ্জিন চালক হুমায়ুন কবির নিখোঁজ থাকলেও বাকিদের জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে।
অন্যদিকে ফেরিতে থাকা প্রত্যক্ষদর্শী ট্রাকচালক আশিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, গতকাল মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে ফেরিটি দৌলতদিয়া ঘাট থেকে ছেড়ে আসে। কিন্তু নদীতে কুয়াশার কারণে ফেরির মাস্টার রাত দেড়টার দিকে নদীতে নোঙর করে। সকাল সাড়ে ৬টার দিকে চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙে যায়। এ সময় একজন বলতে থাকেন, ফেরিতে পানি উঠছে। তখন ফেরির মাস্টার নোঙর তুলে ফেরিটি তীরে নিয়ে আনার জন্য চালু করলেও ততক্ষণে পানি ওঠে ফেরিটি একদিকে কাত হয়ে ডুবতে থাকে। ফেরির তলা ফেটে পানি ডুকেছে বলেই ফেরিটি ডুবে গেছে। তা না হলে ফেরি কেন ডুববে। সকাল সোয়া ৮টার দিকে ফেরিটি যানবাহন নিয়ে পানিতে তলিয়ে যায়।
আশিকের দাবি, কোনো বাল্কহেড বা অন্য কোনো ফেরি বা নৌযানের ধাক্কায় এ ঘটনা ঘটেনি। ফেরিতে পানি ওঠে কাত হয়ে তলিয়ে যায়। জীবন বাাঁচাতে নদীতে ঝাঁপ দেই। প্রায় ৩০ মিনিটি পানিতে ভেসে ছিলাম। পরে ট্রলার এসে আমাদের উদ্ধার করেছে।
ফেরিতে থাকা আরেক প্রত্যক্ষদর্শী ট্রাকচালক মজনু বলেন, ভোর সাড়ে ৪টার দিকে ফেরিতে পানি উঠতে থাকে। এ সময় ফেরির লোকজন পানি নিষ্কাশন করার চেষ্টা করলেও ধীরে ধীরে ফেরিটির এক পাশ কাত হয়ে ডুবতে থাকে। একপর্যায়ে সকাল সোয়া ৮টার দিকে সব মালবাহী ট্রাক নিয়ে ফেরিটি পানিতে তলিয়ে যায়। এ সময় আমরা যে যার মতো জীবন বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে তীরে উঠি।
ফেরিডুবির ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট পৃথক দুটি এবং বিআইডব্লিউটিসির পক্ষ থেকে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সানজিদা জেসমীনকে প্রধান করে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। সাত কার্যদিবসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
এছাড়াও বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান মতিউর রহমান বলেন, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত (রাত ১০টা) পাটুরিয়ায় ফেরিডুবির ঘটনায় ২০ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হলেও ফেরির ইঞ্জিন চালক হুমায়ুন কবির নিখোঁজ রয়েছেন। তবে ডুবে যাওয়া ফেরি থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত উদ্ধারকারী জাহাজ হামজার মাধ্যমে দুটি ট্রাক উদ্ধার করা হয়েছে। নদীতে কুয়াশার পরিমাণ বেড়ে গেলে এই উদ্ধার কাজ আজকের মতো সমাপ্ত করা হবে।
এদিকে আগামীকাল বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে আরেক উদ্ধারকারী জাহাজ ‘প্রত্যয়’ ডুবে যাওয়া ফেরি রজনীগন্ধা উদ্ধারে পাটুরিয়া ঘাট এলাকায় আসতে পারে বলে জানান বিআইডব্লিউটিসির আরিচা কার্যালয়ের বাণিজ্য শাখার উপমাহব্যবস্থাপক শাহ মো. খালেদ নেওয়াজ।
আরএআর