‘ব্যাটার বউয়ের অত্যাচার সহ্য করতি না প্যারি চলি আইছি’
‘ছেলে কী কবি (বলবে), মার (মা) দিক দেখফি (দেখবে), না বউয়ের এর দিক দেখফি। ব্যাটার (ছেলে) ভাত, বউয়ের হাত। মায়ের দিক দেখলি তো আর বউ পাবি না ব্যাটা। ব্যাটার বউয়ের অত্যাচার সহ্য করতি (করতে) না প্যারি (পেরে) এখানে আমি একা একাই চলি (চলে) আইছি।’
এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন ৬৫ বছর বয়সী সুফিয়া বেগম। তিনি তিন বছর ধরে রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার শিলমারী ইউনিয়নের সাধানপুর গ্রামে ‘বয়স্ক প্রতিবন্ধী নিরাশ্রয় বৃদ্ধবৃদ্ধাদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে’ থাকেন। সুফিয়া বেগমের মতো আরও ১০ জন বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ এখানে থাকেন।
বিজ্ঞাপন
সুফিয়া বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘একা একা চলি আসার পরে ব্যাটা শুনি আইছিল। আমি যাইনি। ব্যাটাকে বুলিছি, বাপ তুমি যাও। আমি এখিনে (এখানে) ভালো আছি। আমি যেহেতু এখিনে আছি, তাই গার্জিয়ান (অভিভাবক) হিসেবে খাতাতে নাম লেখতি হিবি (হবে)। তাই ব্যাটা নাম লেখি দি চলি গ্যাছে। আমার ব্যাটারা (ছেলে) যেটুক দেখে, বউয়েরা দেখে না। সেই কারণেই এখিনে চলে আইছি। আমার দুই ব্যাটা, দুই বিটি (মেয়ে)। এক বিটি মরি (মারা) গেছে। এক বিটি (মেয়ে) পরের সংসারে থাকে। ব্যাটার বউয়ের অত্যাচারের কারণে মানুষের মুখে মুখে শুনি (শুনে) এখিনে চলি আইছি। এখিনে বাড়ির চ্যাতে (চেয়ে) ভালো আছি। সবাই মিলে-মিশে বন্ধু-বান্ধবীর মুতন (মতো) থাকি।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পুঠিয়া বাজার থেকে তাহেরপুর সড়কে ধোপাপাড়া দিয়ে বাসুপাড়া বাজার। বাসুপাড়া থেকে মোল্লাপাড়াহাট হয়ে একই সড়কে সাধানপুর বাজার। সাধানপুর বাজার থেকে আধা কিলোমিটার দূরে বৃদ্ধাশ্রম। আর সাধানপুর বাজার থেকে এক কিলোমিটার দূরে পঙ্গু নিকেতন। এখানে রয়েছে পঙ্গু শিশু নিকেতন প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ডিগ্রি কলেজ, বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ, অন্ধ শিক্ষা কার্যক্রম, পঙ্গু শিশুদের আবাসস্থল, বৃদ্ধাশ্রম ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে। এতে পঙ্গু ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা করে থাকেন।
এই বৃদ্ধাশ্রমের আরেক বাসিন্দা নাটোরের ভ্রম্যপুরের ইসমাইল হোসেন (৬৭)। তিনি আছেন তিন মাস ধরে। স্ত্রী, দুই ছেলে, দুই মেয়েকে মানুষ করতে ৪০ বছর চাকরি নামের ঘানি টেনেছেন প্রাইভেট কোম্পানিতে। তার নিজের নামে ছিল বাড়ির জায়গা ছাড়াও আট বিঘা জমি। কিন্তু এই আট বিঘা জমিতে তার জায়গা হয়নি। জায়গা হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে।
ইসমাইল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সম্প্রতি তিনি দুই ছেলেকে বাড়ির জমি রেজিস্ট্রি করে দেন। তারপর থেকে ছেলেরা বাড়িতে থাকতে দেয় না। অসহায় অবস্থায় জায়গা না পেয়ে এখানে আছি। ছেলেরা ব্যবসা ও কৃষি কাজ করে। নিজের জমি সাত থেকে আট বিঘা জমি আছে। সব জমিই রেজিস্ট্রি করে দেইনি। কিছু জমি আছে আমার নামে। জমি ছেলেমেয়েদের যা দিয়েছি সমান করে। কিন্তু বাড়ির জমি দুই ছেলেকে দিয়েছি। এই কারণে আর বাড়িতে আমার জায়গা হয়নি।
বৃদ্ধাশ্রমের আরেক বাসিন্দা শাহাদাত হোসেন (৬৫)। তার বাড়ি রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার পালঘরিয়া এলাকায়। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এটি (বৃদ্ধাশ্রমে) মাস চারের মতো হলো আছি। ছেলে-মেয়েরা দেখে না। ওরা ফ্যালা থু ছিল। পাড়া-প্রতিবেশী এক ভাতিজা এখানে রেখে গেছে। আমার চার ছেলে, মেয়ে নেই। ছেলেরা দেখাশোনা করে না। তারা কৃষি কাজ করে। আমি প্যাঠের (জমিতে কাজ করা শ্রমিক) কাজ-কাম করে তাদের মানুষ করতে গিয়ে এখন হাত-পাও অচল হয়ে গেছে। এখন ঠিক মতো হাঁটতেও পারি না। এখন আমার জমি জায়গা নাই, বাড়িডাও নাই।
বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা শ্রী খোকা বাবু (৬০)। তারও বাড়ি বাগমারার কামারখালী এলাকায়। এখানে ছয় মাস থেকে আছেন তিনি। তার জীবনের গল্পটা সুফিয়া, শাহাদাত ও ইসমাইলের চেয়ে আলাদা। খোকা বাবুর নামে ২৫ থেকে ৩০ বিঘা জমি রয়েছে। তবে দত্তক নেওয়া ছেলের নির্যাতনের শিকার তিনি। তার ভাষ্য তিনি জীবন বাঁচানোর জন্য আশ্রয় নিয়েছেন বৃদ্ধাশ্রমে।
খোকা বাবু ঢাকা পোস্টকে বলেন, জীবন রক্ষা করার জন্য এখানে এসেছি। আমার দুইটা মেয়ে ছিল। ছেলে হওয়ার পরে স্ত্রী মারা যায়। পুনরায় একটা বিয়ে করি, স্ত্রীর ছেলেসহ। তখন ছেলের (তাপস) বয়স ছিল ১৫ বছর। সেই ছেলে বড় হয়ে টাকা-পয়সার জন্য আমাকে অত্যচার করে। আমাকে মারধর করে হাত-পা ভেঙে দিয়েছে। কোমড় ভেঙে দিয়েছে। আমি প্রাণের ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম। অনেক দূরে এক মুসলিমের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। তিনি আমাকে এখানে (বৃদ্ধাশ্রমে) রেখে গেছেন। সেই থেকে এখানে আছি। ছেলে (তাপস) এখানেও আক্রমণ করেছিল। কিন্তু আমাকে মারতে পারেনি।
তিনি আরও বলেন, ওই ছেলেকে জমি বিক্রি করতাম ও টাকা দিতাম। তাও আমাকে মারধর করত। আমার কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ বিঘা জমি আছে। আমি আর বাড়িতে যাব না। আমি এখানেই থাকব। আমি আমার কিছু জমি বিক্রি করে এই বৃদ্ধাশ্রমে দেব। আমি মারা গেলে, আমার দেহ যেন কাউকে না দেওয়া হয়। আমি এখানে আসার পর খবর পেলাম আমার পালিত ছেলে মারা গেছে। তার শরীরের ওপর দিয়ে ট্রাক চলে গেছে। সে আমাকে মেরেছে দিনে দিনে, অকে (তাপস) মেরেছে একদিনে। আমি বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেওয়ার পর সড়ক দুর্ঘটনায় সে মারা গেছে।
বৃদ্ধাশ্রম দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা নাসির উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে বিনা খরচে তারা থাকেন। এখানে খাওয়া-দাওয়া ছাড়াও প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে।
পঙ্গু শিশু নিকেতনের সভাপতি মো. মুরছালাত বলেন, এই প্রতিষ্ঠানে সরকারিভাবে সহযোগিতা পাওয়া যায় না। এখানে আমাদের আয়ের কিছু উৎস আছে যেমন পুকুর, ধানি জমি ও বিভিন্ন ফলের গাছ ইত্যাদি। সেই টাকায় কোনো মতে চলে।
শিলমারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসেন মুকুল বলেন, প্রতিষ্ঠানটি সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা পায় না। ব্যক্তি উদ্যাগে কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। পঙ্গুদের শিক্ষা, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে। সেখানে কিছু নারী-পুরুষ রয়েছে। সরকারি বা এনজিওগুলোর সহযোগিতা পেলে এটি ভালোভাবে চলতো।
শাহিনুল আশিক/আরএআর