যে কারণে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরে গেলেন তিনবারের এমপি ইনু
কুষ্টিয়া-২ (মিরপুর ও ভেড়ামারা) আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে টানা তিনবার সংসদ সদস্য (এমপি) নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু। তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে ২৩ হাজার ভোটে হেরে গেছেন তিনি।
হাসানুল হক ইনুকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী কামারুল আরেফিন। স্বতন্ত্র প্রার্থী কামারুল আরেফিন ট্রাক প্রতীকে ১ লাখ ১৫ হাজার ৭৯৯ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হাসানুল হক ইনু নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন ৯২ হাজার ৪৪৫ ভোট।
বিজ্ঞাপন
এদিকে ইনুর পরাজয়ের পর স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলেছেন। তাদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের খোঁজখবর রাখেন না ইনু। উল্টো নির্যাতন, নিপীড়ন, অপমান, অবহেলা ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেন। এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী উন্মুক্ত করে দেওয়ার পর নির্বাচনের হাওয়া ঘুরে যায়। মিরপুর ও ভেড়ামারা উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বড় একটি অংশ বাধ্য হয়ে আওয়ামী লীগকে বাঁচাতে মিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যানকে স্বতন্ত্র প্রার্থী করেন। গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে নানা কারণে দ্বন্দ্ব প্রকট হয় ইনুর। ফলে এবার বিরোধিতার মুখে পড়ে তিনি হেরে যান।
এ বিষয়ে মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হালিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি। গত ১৫ বছরে আমরা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নির্যাতিত হয়েছি। সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। গত ৫ বছরে ৫ বারও আমার খোঁজ নেননি ইনু। তার সাথে আমার কথাও হয়নি। আমি যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হয়েছি, সেখানে অনুদান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই কারণে মিরপুর ও ভেড়ামারা উপজেলার নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগ থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কামারুল আরেফিনকে নির্বাচনে দাঁড় করানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ইনুর ১৫ বছরের নির্যাতন-নিপীড়নের ফসল হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হয়।
তিনি বলেন, উনি (ইনু) শুধুমাত্র নৌকা প্রতীক নিয়ে এসে এমপি হন, পরবর্তীতে জাসদ হয়ে যান। এই কারণে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও এলাকার মানুষের ক্ষোভ রয়েছে। সেই ক্ষোভের প্রতিফলন ঘটেছে এই নির্বাচনে। নৌকার বৈঠা মারি আমরা, মিরপুর ও ভেড়ামারায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব আছে। সেটা আমরা দেখিয়ে দিয়েছি। ইনু নৌকা নিয়ে তিনবার জিতেছেন। এবার প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে জাসদের বিরুদ্ধে আমরা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কামারুল আরেফিনকে জয়যুক্ত করেছি। মিরপুর ভেড়ামারায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সুসংগঠিত
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জানান, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ভোটে ইনু তিনবার এমপি হয়েছেন। এমপি হওয়ার পর তিনি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ভুলে যান। নির্যাতন ও অবহেলা করেন। সেই ক্ষোভে ভেড়ামারা-মিরপুরের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা একাট্টা হয়ে কামারুলের ট্রাক প্রতীকের পক্ষে লড়াই করেন। কামারুলের সঙ্গে মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হালিম, ভেড়ামারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রফিকুল আলম চুন্নু, সাধারণ সম্পাদক সামিউল ইসলাম সানা ও উপজেলা চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান মিঠুর মতো শীর্ষ নেতারা ছিলেন।
জাসদের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি ইনুর সঙ্গে ছিলেন মিরপুর পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র এনামুল হক, মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রবিউল হক রবি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল মালিথা, আতাহার আলীসহ অনেকেই।
এ বিষয়ে কথা বলতে কুষ্টিয়া জেলা জাসদের সভাপতি গোলাম মহসিন, মিরপুর উপজেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক আহম্মদ আলী ও সাংগঠনিক সম্পাদক আফতাব উদ্দিনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তারা রিসিভ করেননি। মিরপুর ও ভেড়ামারা উপজেলা জাসদের অন্যান্য একাধিক নেতার মুঠোফোনও বন্ধ পাওয়া গেছে।
নির্বাচনে পরাজয়ের পর যোগাযোগ করা হলে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ১৫ বছর এই অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে হাঁটছি-চলছি। আমি আমার সাধ্যমতো এই এলাকার মানুষের পাশে থেকে উন্নয়ন করছি, শান্তির পথ তৈরি করেছি। সবাই খুশি হবে আমি তা মনে করি না। গত ১৫ বছরে ইনু অনিয়ম, দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, ঘুষ বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য করেনি।
নবনির্বাচিত সংসদ সদস্য কামারুল আরেফিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, মিরপুর ও ভেড়ামারা উপজেলার মানুষের কল্যাণে এবং শান্তির জন্য আর্থসামাজিক উন্নয়নসহ সার্বিক উন্নয়নে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখবো।
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ১৯৯১ সাল থেকে ২০০১ পর্যন্ত জাসদের দলীয় প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে পরাজিত হন। ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের শরিক হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে জয়ী হন। ইনুকে চ্যালেঞ্জ করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামারুল আরেফিন গত ২৮ নভেম্বর পদত্যাগ করেন। দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ায় মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামারুল আরেফিন কুষ্টিয়া-২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করেন এবং এমপি নির্বাচিত হন। ছাত্রলীগের রাজনীতির মাধ্যমে উঠে আসা এই নেতা দলের তৃণমূলেও বেশ জনপ্রিয়।
আরও পড়ুন
আশির দশকে ছাত্রলীগের রাজনীতির মাধ্যমে রাজনীতি শুরু করেন কামারুল আরেফিন। এরপর তিনি যুবলীগের রাজনীতি শুরু করেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে ছিলেন। পরে হামলা-মামলায় টিকতে না পেরে এলাকা ছেড়ে চলে যান। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি এলাকায় ফিরে আসেন। ২০১১ সালে মিরপুর উপজেলার সদরপুর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) থেকে নির্বাচন করে চেয়ারম্যান হন বিপুল ভোটে। পরে তিনি মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। ২০১৪ সালের পর ইউপি চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচন করে জয়ী হন। এরপর ২০১৮ সালেও একই পদে জয়ী হন।
প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে ২০১৯ সালে বাংলাদেশের সেরা উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে সম্মাননা লাভ করেন কামারুল আরেফিন। ২০১৯ সালের ১৩ মার্চ রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে তিনি সম্মাননা গ্রহণ করেন। এছাড়া বিভিন্ন কৃতিত্বের জন্য উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে বিভিন্ন সম্মাননা লাভ করেছেন কামারুল আরেফিন।
রাজু আহমেদ/আরএআর