দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। রোববার (৭ জানুয়ারি) সকাল ৮টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হবে। চলবে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। ভোটগ্রহণ শেষে গণনা ও ঘোষণা করা হবে ফলাফল। এবারের নির্বাচনে খুলনার ৬টি আসনে ১১টি রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মিলিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৩৯ প্রার্থী। যার মধ্যে নারী প্রার্থী মাত্র দুইজন। ছয়টি আসনের মধ্যে খুলনা-১, ২ ও ৩ আসনে নৌকার জোড়ালো কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নেই বলে জানান ভোটাররা। তবে খুলনা ৪, ৫ ও ৬ আসন তিনটিতে নৌকার প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। এমনটাই জানিয়েছেন দলীয় নেতাকর্মী ও ভোটাররা।

জানা গেছে, খুলনা-১, ২ ও ৩ আসনে জয়ের ব্যাপারে নৌকার প্রার্থীরা ফুরফুরে মেজাজে রয়েছেন। ফাঁকা মাঠে তারা জয়ের বিকল্প কিছু না ভাবলেও তাদের ভাবনা রয়েছে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে। কারণ অসম লড়াইয়ের কারণে তিনটি আসনেই ভোটারদের মধ্যে আগ্রহ কম। এ অবস্থায় সহজ জয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের কঠিন চ্যালেঞ্জ ভোটার উপস্থিতি।

খুলনা-১ আসনে প্রার্থী ৪ জন। তারা হলেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও সাবেক সংসদ সদস্য ননী গোপাল মন্ডল, জাতীয় পার্টির কাজী হাসানুর রশিদ, তৃণমূল বিএনপির গোবিন্দ চন্দ্র প্রামানিক ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক সচিব প্রশান্ত কুমার রায়। এর মধ্যে ননী গোপাল মন্ডলের পক্ষে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা একাট্টা।

সাবেক সচিব প্রশান্ত কুমার আওয়ামী লীগের অনুসারী হলেও তার পক্ষে নামেনি দলের অধিকাংশ নেতাকর্মী। তৃণমূল বিএনপির গোবিন্দ চন্দ্র এলাকায় গণসংযোগ করলেও কোনো অবস্থান তৈরি করতে পারেননি। জাতীয় পার্টির প্রার্থী কাজী হাসানুর রশিদের প্রচারণা ছিল না বললেই চলে। ফলে এ আসনে সহজেই নির্বাচনী বৈতরণি পার হতে পারছেন নৌকার প্রার্থী।  

খুলনা-২ আসনে ৭ প্রার্থীর মধ্যে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও প্রধানমন্ত্রীর চাচাতো ভাই শেখ সালাহ উদ্দিন জুয়েলের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। প্রার্থীদের মধ্যে বাংলাদেশ কংগ্রেসের দেবদাস সরকার, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের বাবু কুমার রায়, গণতন্ত্রী পার্টির মো. মতিয়ার রহমান, বিএনএম’র মো. আব্দুল্লাহ আল আমিন ভোটের মাঠে অপরিচিত মুখ এবং নতুন প্রার্থী। জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো. গাউসুল আজম তেমন প্রচারণা চালাননি। অন্য প্রার্থী স্বতন্ত্র মো. সাঈদুর রহমান সংসদ সদস্য শেখ জুয়েলের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা। ফলে এ আসনে নির্বাচন নিয়ে নির্ভার রয়েছেন নৌকার প্রার্থী শেখ জুয়েল।  

খুলনা-৩ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী দলটির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেনেরও শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। এ আসনের প্রার্থী জাকের পার্টির এস এম সাব্বির হোসেন গণসংযোগ করলেও ভোটের মাঠে তিনি দুর্বল প্রার্থী। জাতীয় পার্টির মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন প্রার্থী হলেও ছিল না তেমন প্রচার-প্রচারণা। স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগের ফাতেমা জামান সাথী ভোটের মাঠে নতুন মুখ। ফলে এ আসনেও আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সহজ জয় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

এদিকে খুলনা-৪, ৫ ও ৬ আসনে নৌকার সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলছেন দলের নেতাকর্মীরা।

খুলনা-৪ আসনের (রূপসা, তেরখাদা ও দিঘলিয়া) ১২ জন প্রার্থী থাকলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ মনোনীত আব্দুস সালাম মূর্শেদী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া আওয়ামী লীগের এস এম মোর্ত্তজা রশিদী দারা। সালাম মূর্শেদী এ আসনের ২ বার সংসদ সদস্য ও শিল্পপতি। আর দারা এ আসনের ৩ বারের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত এস এম মোস্তফা রশিদী সুজার ভাই। দারা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি।

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জানান, এ আসনের ৩টি উপজেলা ও ইউনিয়নগুলোতে দলের নেতাকর্মীরা ২ প্রার্থীর পক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন।

খুলনা-৫ (ডুমুরিয়া ও ফুলতলা) আসনে মোট প্রার্থী ৫ জন। এর মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও ডুমুরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নারায়ন চন্দ্র চন্দ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া ফুলতলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আকরাম হোসেন। নারায়ন চন্দ্র এ আসনের ৪ বারের সংসদ সদস্য এবং শেখ আকরাম হোসেন ফুলতলা উপজেলা পরিষদের ৪ বারের চেয়ারম্যান।

দলের নেতাকর্মীরা জানান, দলের নেতাকর্মীরা দুই প্রার্থীর পক্ষে বিভক্ত হয়ে প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। তাদের পাল্টাপাল্টি প্রচারণায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে।

এছাড়া খুলনা-৬ (পাইকগাছা ও কয়রা ) আসনে ৭ জন প্রার্থী থাকলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে আওয়ামী লীগ মনোনীত মো. রশীদুজ্জামান মোড়ল ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ জি এম মাহবুবুল আলমের মধ্যে। এ আসনটিতে নৌকা ও ঈগলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

নৌকার প্রার্থী মো. রশীদুজ্জামান মোড়ল বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। নির্বাচনে নেতাকর্মীরা আমার সঙ্গে রয়েছে। ভোটাররা উৎসবমুখর পরিবেশে কেন্দ্রে ভোট দিতে আসবে।

কেন্দ্রে কেন্দ্র নির্বাচনী সরঞ্জাম  

৭৯৩টি ভোট কেন্দ্রে পৌঁছে গেছে ব্যালট বাক্সসহ নির্বাচনী সরঞ্জাম। রোববার (৭ জানুয়ারি) ভোর থেকে কেন্দ্রে কেন্দ্রে পাঠানো হবে ব্যালট পেপার। খুলনা সার্কিট হাউজ থেকে শনিবার (৬ জানুয়ারি) বেলা ১১টায় খুলনা ২ ও ৩ আসনের ব্যালট বাক্সসহ নির্বাচনী সরঞ্জাম ভোট কেন্দ্রগুলোতে পাঠানো হয়। এ ছাড়া অন্য চারটি আসনের নির্বাচনী সরঞ্জাম সকাল ১০টা থেকে ৯টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে ভোট কেন্দ্রগুলোতে পাঠানো হয়। বিকেলের মধ্যেই নির্বাচনী সরঞ্জাম কেন্দ্রে কেন্দ্রে পৌঁছে যায়। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তারা রাতে ভোট কেন্দ্রেই থাকবেন।  

রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন জানান, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী শনিবার দিনের বেলা ব্যালট পেপার ভোটকেন্দ্রে পাঠানো হয়নি। ভোর ৪টা থেকে ব্যালট কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হবে। নির্বাচনী পরিবেশ সুন্দর রয়েছে। খুলনায় ৭৯৩টি ভোট কেন্দ্রে ভোট কক্ষ রয়েছে ৪ হাজার ৭২০টি।

ভোটের মাঠে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ১৭ হাজার সদস্য

রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন জানান, সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। ভোট কেন্দ্রসহ গোটা জেলা জুড়ে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ভোট কেন্দ্রসহ গোটা জেলার নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করবেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর প্রায় ১৭ হাজার সদস্য। নির্বাচনে জেলা পুলিশের ২ হাজার ১৪২ জন, মেট্রোপলিটন পুলিশের ৩ হাজার ৮৩ জন, ৯ হাজার ৫৮৮ জন আনসার, র‌্যাবের ৯৬ জন, দাকোপ উপজেলা ও কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নে কোস্টগার্ডের ৫৯৬ জন, ১৯ প্লাটুন বিজিবি, সেনাবাহিনীর ৬০০ জন ও নৌ পুলিশের ১৩ জন দায়িত্ব পালন করছেন।  

৭৯৩টি কেন্দ্রের মধ্যে ৫৪৮টিই গুরুত্বপূর্ণ

ভোট কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ৫৪৮টি কেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ ও ২৪৫টি কেন্দ্র সাধারণ। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি কেন্দ্রে ৪ জন পুলিশ ও ১২ জন আনসার দায়িত্ব পালন করবে। আর নগরীর সাধারণ কেন্দ্রে তিনজন পুলিশ ও ১২ জন আনসার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে। জেলার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি কেন্দ্রে তিনজন পুলিশ ও ১২ জন আনসার দায়িত্ব পালন করবে। আর জেলার সাধারণ কেন্দ্রে দুইজন পুলিশ ও ১২ জন আনসার নিরাপত্তার দায়িত্বে  থাকবে। এ ছাড়া ৬৪৬ জন দফাদার থাকছেন। নির্বাচনের মাঠে থাকছেন ৪৬ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও ১৫ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। এবারের নির্বাচনে পর্যবেক্ষক রয়েছে ১২টি বেসরকারি সংস্থার ১১৫ জন। এ ছাড়া ভারতের নির্বাচন কমিশনের মুখ্য সচিব মোহাম্মদ উমর নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন।

দায়িত্বে থাকবেন প্রায় ১৫ হাজার ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা

খুলনার সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ফারাজী বেনজীর আহমেদ জানান, নির্বাচনের দিন ৭৯৩ জন প্রিসাইডিং অফিসার, ৪ হাজার ৭২০ জন সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ও ৯ হাজার ৪৪০ জন পোলিং অফিসার দায়িত্ব পালন করছেন। খুলনার ছয়টি আসনে সবমিলিয়ে ১৪ হাজার ৯৫৩ জন ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করবেন।

এবারের নির্বাচনে খুলনার ৬টি আসনে মোট ভোটার ১৯ লাখ ৯৯ হাজার ৮৮২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১০ লাখ ৮৪ জন এবং নারী ভোটার ৯ লাখ ৯৯ হাজার ৭৯৮ জন। ভোট গ্রহণ শেষে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হবে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে।  

এএএ