দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুক্রবার সকাল ৮টায় শেষ হয়েছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রচারের শেষ সুযোগ কাজে লাগাতে মরিয়া ছিলেন প্রার্থী ও সমর্থকরা। নীলফামারীর চারটি আসনের মধ্যে সৈয়দপুর ও কিশোরগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত নীলফামারী-৪ আসন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে এ আসনে প্রতিবারের মতো এবারও অবাঙালি (বিহারি) ভোটারদের নিয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে। প্রার্থীরা তাদের নিজের দিকে টানতে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করছেন। সভা-সমাবেশে বাংলার পাশাপাশি বক্তব্য রেখেছিলেন উর্দুতে। ওই ভাষাতেই করেছেন কুশল বিনিময়। তবে এবারই প্রথম নয়। ভোট এলেই কদর বাড়ে তাদের।

দীর্ঘদিন ধরে নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত এই অবাঙালি ভোটাররা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। ক্যাম্পের ঝুঁপড়ি ঘরে থেকে লেখাপড়া করে অনেকেই হয়েছেন চিকিৎসক। পড়ছেন দেশের নামকরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবাঙালিদের সংগঠনের নেতারা বলছেন, ভোট এলে তাদের কথা মনে পড়ে। এখন আর তারা প্রলোভনে পা দেবেন না। যারা তাদের বসবাসের ব্যবস্থা করবেন ভোট যাবে তাদের পক্ষে।

নীলফামারী-৪ আসনে ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ২৬ হাজার ৮৭ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার ২ লাখ ১২ হাজার ২৩৮ জন, পুরুষ ভোটার ২ লাখ ১৩ হাজার ৮৪৪ জন এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ৫ জন। সৈয়দপুর উপজেলায় মোট ভোটার ২ লাখ ১৫ হাজার ৩৪৮ জন। তাদের মধ্যে পৌর এলাকায় প্রায় ৭৫ হাজার অবাঙালি ভোটার রয়েছেন। যদিও এর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে দ্বিমত আছে। এর মধ্যে একজন অবাঙালি পৌরসভার চেয়ারম্যান (স্বাধীনতার পর) হিসেবে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন।

প্রায় ৭৫ হাজার উর্দুভাষী ভোটার জয়-পরাজয়ের নির্ধারক হিসেবে কাজ করেন। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির সঙ্গে তাদের বরাবরই একটা দূরত্ব লক্ষ্য করা যায়। বিহারিরা দুভাগে বিভক্ত ছিলেন। তাদের মধ্যে একটি অংশ ১৯৪৭-এ ভারত থেকে এসে সৈয়দপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। অন্যরা স্বাধীনতার পর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পালিয়ে এসে এখানকার ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। স্থায়ীভাবে বসবাসকারীরা প্রথম থেকে ভোটার থাকলেও ক্যাম্পে বসবাসকারীরা ভোটার হন ২০০৮ সালে। 

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে ১১টি সংসদ নির্বাচনে নীলফামারী-৪ আসনে নৌকা মার্কার প্রার্থী জয়লাভ করেছেন মাত্র দুবার। এছাড়া স্থানীয় পৌর নির্বাচনে একবার ও উপজেলা নির্বাচনে দুবার আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। বর্তমানে সৈয়দপুর পৌরসভার মোট ভোটারের অর্ধেকই অবাঙালি ভোটার। যেকোনো নির্বাচনে তারা জোটবদ্ধভাবে ভোট দেওয়ায় জয়-পরাজয়ের নির্ধারক হিসেবে কাজ করেন।

তাদের অভিযোগ, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা কখনো তাদের আপন করে নেওয়ার চেষ্টা করেননি। সব সময় অবজ্ঞা করে কথা বলতেন। তবে এখন কিছুটা হলেও সেই ধারায় পরিবর্তন এসেছে। সেই সঙ্গে নতুন প্রজন্মের উর্দুভাষী ভোটারদের মধ্যে ভাবনার পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমান প্রজন্মের অবাঙালিদের একটি বড় অংশ মনে করে, পুরোনো ভাবধারা থেকে বেরিয়ে এ দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে উন্নয়নের ধারার এগিয়ে যাওয়া উচিত।

২২টি ক্যাম্পের প্রতিনিধিত্বকারী বিহারিদের সংগঠন স্ট্যান্ডার্ড পিপলস জেনারেল রিহ্যাবলিটিশন (এসপিজিআরজি) সৈয়দপুর শাখার সভাপতি রিয়াজ আকবর বলেন, বিহারি ভোটাররা কারো পৈতৃক সম্পত্তি নয় যে যেভাবে পারবেন তাদের ব্যবহার করবেন। এখন বিহারিরা অনেক সচেতন। আমাদের ক্যাম্প থেকে অনেকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন। দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় বিহারি ছাত্রদের পদচারণ রয়েছে। তাই তারা এবার বুঝে শুনে ভোট দেবেন। আমাদের আবাসনের সমস্যা সমাধানে যারা এগিয়ে আসবেন ভোট তারা পাবেন।

উর্দুভাষী ক্যাম্প উন্নয়ন কমিটির সভাপতি মাজেদ ইকবাল বলেন, আমরা ক্যাম্পবাসীরা আন্দোলন, সংগ্রাম করে ভোটাধিকার পেয়েছি। ক্যাম্পে বসবাসকারী অনেক ছেলেমেয়ে শিক্ষিত। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন, আমরাও বাংলাদেশের নাগরিক। ভোট এলে অনেকে আশ্বাস দেন, ক্যাম্পবাসীর জীবনমান উন্নয়ন করবেন, বাড়ি করে দেবেন, রাস্তা দেবেন কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় না। আমরা বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। দেশে উন্নতি হলেও আমাদের ভাগ্যের উন্নয়ন হয়নি।

শরিফুল ইসলাম/আরকে