দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণার শেষ সময় চলছে। ভোটের দিন যত ঘনিয়ে আসছে উত্তাপ যেন ততই বাড়ছে। টান টান উত্তেজনায় ভোটের মাঠ গরম করে রেখেছেন প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকরা। নরসিংদীর পাঁচটি আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের টেক্কা দিতে সমান তালে মাঠে প্রচারণা চালাচ্ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এতে জেলার অধিকাংশ আসনে নৌকার প্রার্থীরা ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে মনে করছেন জেলার ভোটার, নির্বাচন বিশ্লেষক ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

জেলার প্রতিটি আসনে সরেজমিনে দেখা গেছে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র থেকে প্রার্থী হয়েছেন একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা। সেই সব স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিজয়ী করতে মাঠে নেমে ভোটারদের কাছে ভোট চাইতে দেখা গেছে সেসব এলাকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। আবার কেউ কেউ প্রকাশ্যে না এসে সেসব এলাকার নৌকার মাঝিকে ডুবাতে আড়াল থেকে কাজ করছেন। আর এতেই রীতিমতো জেলার গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি আসনের মধ্যে অধিকাংশ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর হোঁচট খাওয়ার আলোচনা-সমালোচনায় মেতে উঠতে দেখা গেছে ভোটারদের।

নরসিংদী-১

২০০৮ সালে ১৬ হাজার ৬৫১ ভোটে তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি মনোনীত প্রার্থী খায়রুল কবির খোকনকে পরাজিত করে নরসিংদী-১ আসনের দায়িত্ব পান মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম হিরো (বীর প্রতীক)। তারপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হয়ে জয়লাভ করে টানা তিনবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফের আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম হিরু। তবে এবার জয়লাভ করাটা এত সহজ হবে বলে মনে করছেন না ভোটাররা। কারণ দুইবারের নির্বাচিত সাবেক মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান কামরুল এবার হিরুর বিরুদ্ধে ঈগল প্রতীকের নির্বাচন করবেন। ভোট সুষ্ঠু হলে ভালো লড়াই হবে দুই প্রার্থীর মধ্যে। দুজনই সমানতালে প্রচার চালাচ্ছেন। পক্ষ-বিপক্ষে হুমকি আর গ্রেপ্তারে উত্তেজনাও তৈরি হয়েছে বেশ।

দুটি পৌরসভা ও ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত নরসিংদী সদর আসনে ভোটার আছেন ৪ লাখ ৪১ হাজার ৪৩৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ২৬ হাজার ৭৩৯ জন এবং নারী ভোটার ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৯৭ জন। ভোটাররা কামরুলকে বিজয়ী করবেন, নাকি হিরুকে পর পর চারবার নির্বাচিত করবেন তা জানতে অপেক্ষায় থাকতে হবে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত।

নরসিংদী-২

২০০৮ সালে বিএনপি থেকে নির্বাচিত টানা চারবারের সংসদ সদস্য ড. আবদুল মঈন খানকে ২৯ হাজার ৮২৮ ভোটে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ প্রার্থী ডা. আনোয়ারুল আশরাফ খান। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে আসন ধরে রাখেন তারই ছোট ভাই কামরুল আশরাফ খান পোটন। সর্বশেষ ২০১৮ সালে ডা. আনোয়ারুল আশরাফ খান পুনরায় দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হন। এবারও দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নৌকার কাণ্ডারি হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এই নেতা। এবার নরসিংদী-২ আসনটিতে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি মনোনীত এ এন এম রফিকুল আলম সেলিম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তবে আসনটিতে তার অবস্থান অনেকটাই নড়বড়ে থাকায় এবারও নরসিংদী-২ আসনটিতে নৌকার প্রার্থী ডা. আনোয়ারুল আশরাফ খান কোনো প্রকার চাপ ছাড়াই ধরে রাখতে পারবেন বলে আশাবাদী স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা।

নরসিংদী-৩

আসনটি ১৯৯১ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বিএনপির সাবেক মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভূঁইয়ার দখলে ছিল। পরে ২০০৮ সালে সংস্কারপন্থি হওয়ায় বিএনপি থেকে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন তিনি। সে সময় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী জহিরুল হক ভূঁইয়া মোহনের কাছে ২৬ হাজার ৮০৪ ভোটে পরাজিত হয়ে আসন ছাড়েন আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া। পরে ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী হয়ে দলের বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থী সিরাজুল ইসলাম মোল্লার কাছে পরাজিত হন জহিরুল হক ভূঁইয়া মোহন। সর্বশেষ ২০১৮ সালে ফের আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জহিরুল হক ভূঁইয়া মোহন।

তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জহিরুল হক ভূঁইয়া মোহনকে বাদ দিয়ে এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে ফজলে রাব্বি খানকে। তিনি সাবেক সংসদ সদস্য রবিউল আওয়াল খান কিরণের ছেলে এবং প্রয়াত উপজেলা চেয়ারম্যান ও শিবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি হারুনুর রশিদ খানের ভাতিজা। এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ফজলে রাব্বির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য সিরাজুল ইসলাম মোল্লা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। সিরাজুল ইসলাম মোল্লা এই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য হওয়ায় তার রয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। তাছাড়া বিগত পাঁচ বছর তিনি পুরো নির্বাচনী আসনে চষে বেড়িয়েছেন। এবারের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে দলীয় কোনো বাধা না থাকায় অনেকটা স্বাধীনভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সিরাজুল ইসলাম মোল্লা। এতে আওয়ামী লীগের স্থানীয় বেশির ভাগ নেতা সিরাজুল ইসলাম মোল্লার পক্ষে মাঠে কাজ করছেন। এই আসনে নৌকা হেরে গেলেও বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই, এমনটাই মনে করছেন ভোটাররা।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নরসিংদীর উল্লেখ্যযোগ্য প্রার্থীরা

নরসিংদী-৪

২০০৮ সালে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীনকে ৬৭ হাজার ২০০ ভোটে পরাজিত করে জাতীয় সংসদের এই আসনে বসেন অ্যাডভোকেট নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন। তারপর থেকে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে টানা তিনবারসহ মোট চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফের আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পান নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন। তিনি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভের পর বাংলাদেশ সরকারের শিল্পমন্ত্রীর দ্বায়িত্ব পান। তবে এবার জয় পাওয়াটা এতটা সহজ হবে না বলে মনে করছেন স্থানীয় নেতারা।

এ আসনে তার বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন মনোহরদী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম খান বীরু। তিনি একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আশায় বিগত সময়ে বেলাবো-মনোহরদী নির্বাচনী এলাকা চষে বেড়িয়েছেন। সাইফুল ইসলাম খান বীরু সাবেক সেনাপ্রধান ও সাবেক মন্ত্রী নুরুদ্দিন খানের ভাতিজা হওয়ায় এলাকায় তার রয়েছে ব্যাপক প্রভাব-প্রতিপত্তি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে এই নেতা নির্বাচনী এলাকার দুই উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন, গ্রাম, পাড়া-মহল্লা চষে বেড়াচ্ছেন। ভোটারদের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন, ঈগল প্রতীকে ভোট প্রার্থনাসহ ভোটারদের দোয়া কামনা করছেন তিনি। ভোটাররাও শোনাচ্ছেন আশার বাণী।

তাছাড়া বেলাবো-মনোহরদী এই দুই উপজেলার আওয়ামী লীগের দলীয় নেতারা মনে জানা-অজানা ক্ষোভ নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী বীরুর হয়ে মাঠে কাজ করছেন। ইতোমধ্যে বেলাবো-মনোহরদীর বাতাসে ভোটারদের মাঝে পরিবর্তনের সুর শোনা যাচ্ছে।

নরসিংদী-৫

এই আসনটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রায়পুরা উপজেলার ২৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। ১৯৯৬ সাল থেকে অদ্যাবধি এ আসনটি ধরে রেখেছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য এবং সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু। এই আসনটি থেকে টানা পাঁচবারসহ মোট ছয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। জেলার প্রবীণ এই নেতাকে সম্মানিত করতে আবারও তার হাতে নৌকা তুলে দেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের কোনো ধরনের বাধা না থাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান চৌধুরী। ইতোমধ্যে তিনি রায়পুরার ২৪টি ইউনিয়নে ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে তাকে। এতে করে এ আসনটিতে এবার নৌকা ও ঈগল প্রতীকের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলে মনে করছেন অনেকে৷

তবে বর্ষীয়ান নেতা রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর এলাকায় এখনো রয়েছে তার বেশ জনপ্রিয়তা। এখনো তিনি শক্ত হাতে রায়পুরা পরিচালনা করেন। তবে দলীয় কিছু নেতাকর্মী তার উপর রাগ-অভিমান নিয়ে ঈগল প্রতীকের প্রার্থীর হয়ে কাজ করছেন। তাই এ আসনটিতে নৌকার জয় এতটা সহজ হবে বলে মনে করছেন না ভোটাররা। তবে শেষ পর্যন্ত এবার কার দখলে যাবে এই আসন জানতে হলে অপেক্ষা করতে হবে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত। 

এমজেইউ