অগ্রহায়ণের শেষ বেলায় এসে ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে রংপুর। তিস্তা-ঘাঘট, করতোয়া-যমুনেশ্বরী বেষ্টিত এ জেলার প্রকৃতি ঘন কুয়াশার চাদরে আচ্ছাদিত। ভোরে সূর্যোদয় হলেও কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশে নিখোঁজ রয়েছে আলোর ঝলকানি। সকাল পৌনে ১০টা পর্যন্ত কুয়াশার কারণে সূর্যের মুখ দেখা যায়নি।

সোমবার (১১ ডিসেম্বর) ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত ঘন কুয়াশার দাপট দেখা গেছে। শহরের পিচঢালা সড়কগুলোও ভিজেছে ঘন কুয়াশার শিশিরবিন্দুতে। গাছগাছালি ভরা সবুজ-শ্যামল প্রকৃতিও কুয়াশায় ধোঁয়াচ্ছন্নরূপ পেয়েছে।

এ অবস্থায় ভোর থেকে সড়ক-মহাসড়কগুলোতে ছোট-বড় যানবাহনগুলোকে চলাচল করতে হচ্ছে হেডলাইট জ্বালিয়ে। দুর্ঘটনা এড়াতে রেলপথেও গতি কমেছে ট্রেনের। ঘন কুয়াশার কারণে ট্রেনের শিডিউল নড়বড়ের শঙ্কা রয়েছে।

এদিকে, ভোর থেকে সকাল দশটা পর্যন্ত রংপুর নগরের শাপলা চত্বর, নিউ আদর্শপাড়া, বাবুখাঁ, কামারপাড়া, লালবাগ, টার্মিনাল রোডসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ঘন কুয়াশার দাপটে সড়কে মানুষের উপস্থিতি কম। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্মস্থলে উদ্দেশ্যে বের হওয়া মানুষ ঠিকই দেখা গেছে। তাদের কষ্ট বেড়েছে সড়কে নিত্য চলাচলের বাহন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা কম থাকায়। এজন্য তাদের গুণতে হয়েছে বাড়তি ভাড়াও। 

রংপুর আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সোমবার রংপুরে সকাল নয়টা পর্যন্ত তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ১৫ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর সূর্যোদয় হয়েছে ভোর ৬টা ৪০ মিনিটে। তবে সকাল দশটা পর্যন্ত সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। 

রোববারের চেয়ে আজ তাপমাত্রা বাড়লেও কুয়াশার ঘনত্বও কমেনি। রোববার রংপুরে ১৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল। মূলত কুয়াশা কেটে গেলে শীত বাড়ে। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না বলে জানান ওই আবহাওয়াবিদ।

আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজুর রহমান জানান, সোমবার সকাল নয়টা পর্যন্ত রংপুরের বিভাগের মধ্যে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়াতে ১৩ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া নীলফামারীর সৈয়দপুরে ১৩ দশমিক ২, ডিমলায় ১৩ দশমিক ৬, কুড়িগ্রামের রাজারহাটে ১৪ দশমিক ৮ এবং গাইবান্ধায় ১৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।

ঘন কুয়াশার সঙ্গে হিমেল হাওয়ায় পথঘাটে থাকা ছিন্নমূল অসহায় মানুষের কষ্ট বাড়িয়েছে। যদিও এই কুয়াশা আগবাড়িয়ে মনে করে দিচ্ছে শৈত্যপ্রবাহের কথা।

শীতের তীব্রতা আরও বাড়ার আশঙ্কায় শঙ্কিত এ জেলার শীতার্ত অসহায় ও দরিদ্র মানুষজন। বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষগুলোর পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র না থাকায় দুর্ভোগও বেড়েছে কয়েকগুণ। নদী তীরবর্তী ও ছিন্নমূল মানুষরা রয়েছেন চরম ভোগান্তিতে। যেন তাদের দুর্ভোগের শেষ নেই। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে শীতের প্রভাব পড়েছে।

রংপুর মহানগরীর শাপলা চত্বরে খাঁন বহুমুখী মার্কেটের মুরগি বিক্রেতা মামুন মিয়া জানান, তীব্র শীতের কারণে বিক্রি অনেক কমে গেছে। হাড়কাঁপানো শীতে জীবিকার প্রয়োজনে দোকান খুলে বসে থাকলেও তাতে তেমন লাভ হচ্ছে না।

কামারপাড়া এলাকার নবীন ইসলাম জানান, সাতসকালে উঠেই সন্তানদের স্কুলে রেখে আসতে হয়। গত কয়েকদিন থেকে ঠান্ডায় তার ছোট মেয়ে ও তিনি সর্দি-কাশিতে ভুগছেন। এমনকি চিকিৎসার জন্য এর মধ্যে সদর হাসপাতালেও গিয়েছিলেন। 

এদিকে শীতজনিত নানা রোগ নিয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে উত্তরাঞ্চলের বহু মানুষ প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসছেন। এরমধ্যে শিশু ও বৃদ্ধা বয়সের মানুষ বেশি। পাশাপাশি আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণে চেষ্টা করা অনেকেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হচ্ছেন।

এদিকে শীতে অসুস্থ নারী, পুরুষ ও শিশুদের জরুরি চিকিৎসার জন্য প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পর্যায়ে মেডিকেল টিমকে গুরুত্বসহ সেবা দিতে নির্দেশ দেওয়া রয়েছে। 

জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. ওয়াজেদ আলী জানান, শীতকালীন রোগে আক্রান্ত শিশু, নারী ও বয়স্কদের সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এ ছাড়াও মনিটরিং টিম রয়েছে।

অন্যদিকে কৃষিজমিতে কাজের জন্য কৃষি শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না, যাদের পাওয়া যাচ্ছে তাদের দিতে হচ্ছে বেশি টাকা। এতে সার, বীজ ও সেচের সঙ্গে কৃষি শ্রমিকের মজুরিতে হচ্ছে বাড়তি খরচ।

কৃষকরা বলেছেন, এমন ঘন কুয়াশা পড়লে কৃষিতে ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। বরাবরই শীতে বোরো বীজতলা ও রবি ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে কোল্ড ইনজুরি ও পচনসহ মড়ক বেড়ে যায়। 

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. এনামুল হক জানান, কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও করণীয় সম্পর্কে তাদের অবগত করা হয়েছে। এ ছাড়াও উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখন যথেষ্ট প্রস্তুতি রয়েছে।

অন্যদিকে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে শীতার্তদের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। 

এ ব্যাপারে রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান বলেন, শীতের শুরুতেই রংপুরে শীতবস্ত্র বিতরণ কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়। ইতোমধ্যে ৪৫ হাজার কম্বল উপজেলা পর্যায়ে বিতরণের জন্য দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আরও ২৫ হাজারের চাহিদা পাঠানো হয়েছে। 

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এমএসএ