ফিরু বেগম

১৯৭১ সালের আজকের দিনে (৮ ডিসেম্বর) মুক্ত হয়েছিল বরিশাল। জেলা ও তৎসংলগ্ন এলাকা স্বাধীনতার স্বাদ পেলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওয়াপদা কলোনীর ১৩টি ভবন তখনো চার শতাধিক আল-বদর সদস্য দখলে রেখেছিল। ১৬ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম বেগের নেতৃত্বে বিশেষ অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা হয় ওয়াপদা কলোনী। এরপরই বেড়িয়ে আসে গণহত্যার নৃশংস নিদর্শন। 

যুদ্ধকালীন ওয়াপদা কলোনীকে ব্যবহার করা হতো বরিশাল বিভাগে পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রধান সামরিক ঘাঁটি হিসেবে। এর দায়িত্বে ছিলেন পাকিস্তান হকি টিমের ক্যাপ্টেন কর্নেল আতিক। বিভাগের সবগুলো জেলায় এই টার্চার সেলে বসেই অপারেশন পরিচালনা করা হতো। ১৩টি ভবন দখলে রাখলেও তার মধ্যে দুটি ভবন ব্যবহার করা হতো টর্চার সেল হিসেবে। এর মধ্যে একটি ছিল নারী নির্যাতনের জন্য। আরেকটি পুরুষদের নির্যাতনের জন্য। এই সেলে কোনো পুরুষ বাঙালি, মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগের কর্মী নিয়ে আসা হলে তাকে ২৪ ঘণ্টার বেশি বাঁচিয়ে রাখা হতো না। সাগরদী খালের ওপর নির্মিত ব্রিজে তুলে বা কখনো খালের পাড়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হতো। গুলির খরচ কমাতে কখনো কখনো আহত মুক্তিযোদ্ধাদের পিটিয়ে হত্যা করা হতো।

এসব খুব কাছ থেকে দেখেছেন ওয়াপদা কলোনীর বাসিন্দা ফিরু বেগম। ১৯৭১ সালে তার বয়স ছিল মাত্র ৯ বছর। তার বাবা পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্পিডবোট চালক ছিলেন। যে কারণে খাল লাগোয়া বড় বিল্ডিংটির দ্বিতীয় নম্বর কক্ষে থাকতেন তারা। দেশ আক্রমণের পর তাদের পরিবারকে ‘ডান্ডি কার্ড’ দেওয়া হলে কোয়ার্টারে থাকতে এবং চলাফেরা করতে কোন সমস্যা হতো না। তারপরও তার মা সব সময় আতঙ্কে থাকতেন। ঘরের চৌকির নিচে বিছানা পেতে সেখানেই সকলকে শোয়ায়ে রাখতেন।

ফিরু বেগম বলেন, সন তারিখ ঠিক মনে নেই। দেশে যুদ্ধ লেগে গেছে এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে ওয়াপদার অধিকাংশ বাসিন্দা নিরাপদে চলে যান। আমার আব্বা স্পিডবোট চালক থাকায় তিনি চাইলেও যেতে পারলেন না। তাকে ডান্ডি কার্ড দেওয়া হলো। একদিন খুব ভোরে উঠে দেখি মিলিটারিরা ওয়াপদা দখলে নিয়ে গেছে। আরেকদিন দেখি খালের পাড়ে বড় বড় চারটি বাঙ্কার তৈরি করছে। আমরা বুঝতাম না ওগুলো কি। মিলিটারিরা যখন এসব বানাচ্ছিল তখন ঘরে দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতাম। তারা চলে গেলে আমিসহ ছোট ছোট যে কয়জন ছেলেমেয়ে কোয়ার্টারে থাকতাম তারা দৌড়ে আসতাম। আব্বা আমাদের ধমকাতেন আর বলতেন কখনো যেন মিলিটারিদের সামনে না পড়ি।

তিনি বলেন, আব্বার কাছে জানতে চাইলাম আব্বা বাঙ্কার কি? তিনি জবাব দিলেন, এখানে মিলিটারি থাকবে। মুক্তিবাহিনী আসলেই বাঙ্কারের ভেতর দিয়ে গুলি করবে। বাঙ্কার বানানোর একদিন পরেই দেখি মিলিটারিরা বন্দুক নিয়ে বাঙ্কারে বসে আছে। সাগরদি খালে কোনো শব্দ পেলেই গুলি ছুড়তো। পুরোদমে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পরে কখনোই আমরা রুমের বাইরে বেড় হতে পারতাম না। আমার ভাই দেলোয়ার হোসেন তখন কলেজের ছাত্র। আব্বা সরকারি চাকরি করেন, আমাদের ডান্ডি কার্ড আছে এসব কারণে সে আর ঘরে থাকতো না। সুযোগ পেলেই বেড়িয়ে যেত। এ নিয়ে আব্বা ঘরে খুব রাগারাগি করতেন মায়ের সাথে। এভাবে ভাই বাইরে যেতে আসতে যেতে আসতে একদিন মিলিটারি আমাদের ঘরে এসে ভাইকে ধরে নিয়ে ঘরের সামনে বেঁধে রাখলো।

ফিরু বেগম বলেন, মিলিটারি আমাদের জানালো দেলোয়ারের নাম মুক্তির তালিকায় পেয়েছে। মা-বাবার তখন কিছুই করার ছিল না। ভাইকে ঘরের সামনের আম গাছটার সাথে বেঁধে নির্মম পিটুনি দিলো। মা-বাবা, আমরা যারা ছোট ভাইবোন খুব কান্নাকাটি করলাম। শেষে আমার ভাইকে গুলি করার জন্য কীর্তনখোলা নদীর তীরে (এখন যেখানে বধ্যভূমি বলে চেনে সকলে) সেখানে নিয়ে গেল। দেলোয়ারকে গুলি করার জন্য দাঁড় করালেও গুলি করার আগেই সে নদীতে ঢলে পড়ে যায়।  নদীতে ভাসতে ভাসতে দূরে গিয়ে উঠে ভিজা কাপড়ে আব্বার অফিস বগুড়া রোডে গিয়ে ওঠে। সেখানে বিস্তারিত জানায়। আব্বা দেলোয়ারকে ওয়াপদা কলোনীতে না এনে তার এক বন্ধুর বাসায় আটকে রাখেন। এভাবে তিন মাস সেখানে থাকলেও মুক্তিযোদ্ধারা দেলোয়ারকে খুঁজতে যেত। দেলোয়ারের সাথে যোগাযোগ করতে যেত। শেষে ওই বাড়ি থেকেও দেলোয়ার একদিন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পালায়। অক্সফোর্ড মিশন রোড এখন যেখানে ওই এলাকায় মিলিটারির হাতে ধরা পড়লে তাকে গুলি করতো। ৭ ডিসেম্বর নিহত হয় দেলোয়ার। ওই রাতেই জিলা স্কুল মাঠে দেলোয়ারের জানাজা শেষে দাফন করা হয়।

তিনি আরও বলেন, টর্চার সেলের সকল নৃশংসতা আমি দেখেছি। খালের পাড়ে আমাদের বাসা থাকায় প্রতিদিন লাশ ভাসতে দেখতাম। প্রতিদিন আসরের আজানের পর আমাদের বাসার সামনে থেকে সারিবদ্ধভাবে মুক্তিযোদ্ধা, বাঙালি, আওয়ামী লীগ কর্মীদের নিয়ে যেত, ব্রিজের ওখানে গুলি করতো। হিন্দু পেলে কোনো কথাই থাকতো না, তাদের মারতো অনেক কষ্ট দিয়ে। আমাদের বাসার সামনে থেকে কাউকে নিয়ে যাচ্ছে দেখার ৪/৫ মিনিটের মধ্যে গুলির শব্দ শুনতাম। এরপরই দেখতাম তাজা রক্ত আর লাশ নদীতে ভাসছে। এখান থেকে ব্রিজের ওখানে হেঁটে যেতে চার-পাঁচ মিনিটই লাগতো। আমরা দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতাম। কোনো দিন চারজন, কোনো দিন পাঁচজন, আবার কোনো দিন ১০-২৫ জনকেও একসাথে গুলি করেছে। আমার স্পষ্ট মনে আছে একদিন সন্ধ্যার ঠিক আগ মুহূর্তে ২২ জনকে নিয়ে গুলি করেছিল। সেদিন আমরা ভাইবোনেরা সকলে ছাদে উঠেছিলাম।

ফিরু বেগম বলেন, তার আগের দুইদিন হঠাৎ করে কাউকে মারছিল না। আমরা স্বাভাবিক হচ্ছে ভেবে মায়ের সাথে বাসার ছাদে উঠি। তখন আসরের নামাজের অনেক পরে। হঠাৎ অনেক লোকের চিৎকার চেঁচামেচি শুনছিলাম। তারপরে দেখি একে একে ২২ জনকে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে মিলিটারিরা। তাদের সকলকে মেরে ফেলে। পর দিন ভোরে খালের ওপারে খুব চিৎকার শুনে আমরা খালের পাড়ে গিয়ে দেখি এক লোককে পিটিয়ে হত্যা করছে মিলিটারিরা। পরে শুনেছি যাকে পিটিয়ে মারা হচ্ছিল তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। সাধারণত একটি হ্যান্ডকাপ দুজনের হাতে পরানো হতো। আগের দিন গুলিতে হ্যান্ডকাপ পরা দুজনের মধ্যে একজনের মৃত্যু হলেও ওই লোকটি বেঁচে যান। কিন্তু হ্যান্ডকাপ খুলতে পারছিলেন না।  তিনি তার হ্যান্ডকাপের সাথে থাকা লাশসহ খালের অপর পারে উঠে ব্রিজের নিচে অপেক্ষা করেন। পরদিন ভোরে লোকজন ডাকতে থাকেন তার হ্যান্ডকাপটি খুলে দেওয়ার জন্য। মিলিটারিরা তা দেখে সেখানে গিয়ে বেঁচে যাওয়া লোককে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে।

তিনি আরও বলেন, তখন আমি শিশুছিলাম বলে দিন তারিখ মনে রাখা সম্ভব না। তবে সেইসব দিনের যেসব চিত্র দেখেছি এখনো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। রাত হলে নারীদের টর্চার সেল থেকে করুণ চিৎকার, কাকুতি-মিনতি, কান্নার শব্দ ভেসে আসতো। আমরা কেউ ঘুমাতে পারতাম না। জাহান্নামের মধ্যে থাকতাম। যেখানে প্রতিটি মিনিট অন্যের মৃত্যু দেখছিলাম। ভাবতাম কখন আমাদের পালা আসে।

ফিরু বেগম বলেন, দেশ স্বাধীন হলেও বিগত ৪৯ বছরেও টর্চার সেল এলাকায় তেমন লোক আসতো না। ভবনগুলো পরিত্যাক্ত ছিল। দুই-তিন বছর হলো টর্চার সেল সংরক্ষণ করা হয়েছে। আমরা কিন্তু থেকে গেছি এখানেই। আমার ভাই মিলিটারির গুলিতে নিহত হলো। আজ পর্যন্ত কেউ আমাদের খোঁজ নেয়নি। আমার মা তিন বছর আগে মারা গেছেন। তিনিও সন্তান হারানোর ঘটনায় একটু সান্ত্বনাও পাননি।

উল্লেখ্য, বরিশাল বিভাগের সবচেয়ে বড় গণহত্যা হয় ওযাপদা কলোনীতে। এখানে ভয়ংকর নির্যাতনের ঘটনার পাশপাশি গণকবরের কথাও জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা ও প্রত্যক্ষদর্শীরা। কেউ কেউ ২০ হাজার বাঙালিকে হত্যার কথা দাবি করলেও ওয়াপদা কলোনী উদ্ধারে নেতৃত্ব দেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রদীপ কুমার ঘোষ পুতুল, পরিমল কুমার ঘোষ, এএমজি কবির ভুল ধারণা করেন ১০ হাজারের মতো মানুষ এই টর্চার সেলে হত্যা করা হয়েছে। এখানে কতজন নারী বন্দী ছিলেন তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি তারা।

ওয়াপদা কলোনি দেশের বড় বড় টর্চার সেল ও গণহত্যার কেন্দ্রগুলোর মধ্যে একটি। এটি ২০১২ সালে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছিল প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরন। কিন্তু তিনি মৃত্যুবরণ করলে সেই উদ্যোগ আর অগ্রসর হয়নি। তবে ২০২০ সালে সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বধ্যভূমিটি সংরক্ষণ করেন। 

আরএআর