ঝালকাঠির বহুকালের পুরোনো ঐতিহ্য শীতলপাটি। একটা সময় ছিল যখন গ্রামের বাড়িতে অতিথি এলে তাকে বসতে দেওয়া হতো শীতলপাটিতে। গৃহকর্তার বসার জন্যও ব্যবস্থা থাকতো এই বিশেষ পাটিতে। বর্তমানে হিন্দুদের বিয়ের অন্যতম অনুষঙ্গ এই শীতলপাটি। দেশের যে কয়টি জেলায় শীতলপাটি তৈরি হয় তার মধ্যে ঝালকাঠি জেলা অন্যতম। দেশ-বিদেশে ঝালকাঠির শীতলপাটি ব্যাপকভাবে সমাদৃত। 

ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার মোল্লার হাট, তিমিরকাঠি, কামদেবপুর সুবিধপুর প্রভৃতি জায়গায় শীতলপাটি তৈরি ও উপকরণ  চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে পাটিকররা। রাজাপুর উপজেলার ৬ নং মঠবাড়ি ইউনিয়ন হাইলাকাঠি, ২নং শুক্তাগড় ইউনিয়নের ডহশংকর সাংগর ও জগন্নাথপুর গ্রামে শিশু, কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে ৭০-৮০ বছরের বৃদ্ধা পাটিকরদের নিপুণ কারুতে শীতলপাটি তৈরি করে ঝালকাঠি জেলায় প্রায় ৬০০ (ছয়শত) পরিবারের চলে সংসার। 

তবে ডিসি অফিস সূত্রে জানা গেছে, এক বছর আগে সরকারি তালিকাভুক্ত ৭৯টি পরিবারের নামের তালিকা তাদের কাছে রয়েছে। তবে পাটিকর সমিতির পরিচালক জানান, তাদের প্রতিবছর পাটিকরদের নিয়ে একটা আয়োজন থাকে সেখানে জেলার সব পাটিকরদের নিমন্ত্রণ করা হয় সেই সূত্রে জেলায় ৬০০টি পরিবার রয়েছে।

জেলা পাটিকরদের দুটি সরকারি রেজিস্ট্রেশনভুক্ত সংগঠন রয়েছে একটি হলো রাজাপুর উপজেলায় আশার আলো শীতল পাটি উন্নয়ন প্রকল্প সমিতি। এটি ২০০৭ সালে সেনাবাহিনী তৈরি করে দেন পাটিকরদের জন্য। এরপর তারা ২০১২ সালে সরকারি রেজিস্ট্রেশন পান। অপরটি হলো নলছিটি উপজেলায় শীতল পাটি শিল্প যুব ফাউন্ডেশন। তারা ২০২২ সালে সরকারি রেজিস্ট্রেশন পান তবে ভবনের কাজ চলমান আছে এখন পর্যন্ত শেষ হয়নি। সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত তারা কোনো প্রশিক্ষণ সহযোগিতা বা সহয়তা পাননি। কয়েক মাস আগে ঝালকাঠি জেলা প্রশাসক ফারাহ গুল নিঝুম পরিদর্শনের সময় পাটিকরদের কাছে গিয়ে সহায়তার আশ্বাস দিলেও এখন পর্যন্ত কোনো সহযোগিতা করেনি এমকি তার কাছে একাধিক বার সহায়তা চেয়ে আবেদন করেও সরকারি কোনো সহয়তা পায়নি বলেন অভিযোগ জানান পাটিকর সমিতির পরিচালক বাবুল দত্ত।

মঠবাড়ি ইউনিয়নের ছোট হাইলাকাঠি ও ডহরশংকর দুটিই শীতলপাটির গ্রাম। কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার সেই ধানসিঁড়ি নদী পাড়ি দিয়ে কিছুদূর গেলেই বিষখালী নদীর তীরে অবস্থিত এ গ্রামটি। শীতলপাটির জন্যই পুরো গ্রাম সুশীতল ছায়ায় আবৃত। চিরন্তন বাংলার প্রাকৃতিক রূপ এই হাইলাকাঠি গ্রামটি অসম্ভব সুন্দর। রাস্তার দু'পাশে রয়েছে পাইত্রার খেত।

বাঙালি ঐতিহ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো শীতলপাটি। গরমে ঠাণ্ডা অনুভূতি পাওয়ার জন্য একসময় ঘরে ঘরে একপাশে লাল কাপড় লাগানো শীতলপাটির ব্যবহার ছিল চোখে পড়ার মতো। আগের মতো ওতো বেশি না হলেও শীতলপাটির ব্যবহার এখনও রয়েছে। ঐতিহ্যের অনুষঙ্গ শীতলপাটি শিল্প, শীতলপাটির গ্রাম ও পাটি শিল্পী, যাদের বলা হয় পাটিকর। তাদের একমাত্র পেশা হচ্ছে পাটি তৈরি করা। সাধারণত ঘরের নারীরাই নিপুণ হাতে পাটি বুননের কাজ করেন। আর পুরুষরা পাটির কাঁচামাল পাইত্রা সংগ্রহ, বেতি তৈরি ও বিপণনের কাজ করেন। গুণগত মান অনুযায়ী কারিগররা একহাজার টাকা থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত একটি শীতল পাটি পাইকারি দরে বিক্রি করেন। 

তবে এই পাটি দেশের বিভিন্ন স্থানের মেলা ও বিপণি বিতানে চড়া দামে বিক্রি হয়। জেলা শহরের পাইকারি দোকান ছাড়াও বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাটির ফড়িয়া আড়তদাররা পাটি বিক্রি করেন। এখন হাল্কা শীত আর রোদে ঘেরা অগ্রহায়ণ মাস চলমান। এ সময়ে বর্ষা স্থায়ী হয়। আর তিন মাস পরেই আবার দেখা মেলবে চৈত্র-বৈশাখের কাঠফাটা রোদ্দুর। তখনই স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়ে যাবে শীতল পাটির কদর।

পাটি শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঝালকাঠির শীতলপাটি বহুকাল ধরে দেশ বিদেশে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। এখানকার চিকন বেতির শীতলপাটির চাহিদাও প্রচুর। এ অঞ্চলে অতিথিদের সামনে একটি ভালো মানের শীতলপাটি বিছিয়ে নিজেদের আভিজাত্যকে ফুটিয়ে তোলা হয়। পাটি শিল্প তাই বাংলাদেশের লোকাচারে জীবন ঘনিষ্ঠ ও ঐতিহ্যবাহী লৌকিক উপাদান। গরমের মৌসুমে এসব পাটি তাপে খুব বেশি গরম হয় না বলেই এটিকে শীতলপাটি বলা হয়। 

শীতলপাটি তৈরিতে ব্যবহৃত পাইত্রার আরেক নাম মোর্তা। এটি এক ধরনের বর্ষজীবী উদ্ভিদ। এদের কাণ্ড থেকে বেতি তৈরি করা হয়। তারপর বেতি থেকে পাটি। পরিপক্ব পাটি গাছ কেটে পানিতে ভিজিয়ে তার পর পাটির বেতি তোলা হয়। এরপর ভাতের মাড় ও পানি মিশিয়ে বেতি জ্বাল দেওয়া হয়। এর ফলে বেতি হয়ে ওঠে মসৃণ ও সাদাটে। বেতির ওপরের খোলস থেকে শীতলপাটি পরের অংশ তুলে বুকার পাটি এবং অবশিষ্ট অংশ ছোটার (চিকন দড়ি) কাজে ব্যবহৃত হয়। 

হাইলাকাঠি ও ডহরশংকর গ্রামে রয়েছে শতাধিক পরিবার। তারা সবাই পাটি বুনে জীবিকা নির্বাহ করে। পুরাতন ঐতিহ্যের কারু হাতে গড়া শীতল পাটির জন্য এ গ্রাম দুটিকে ‘শীতল পাটির’ গ্রামও বলা হয়। এ গ্রামের শত শত হেক্টর জমি জুড়ে রয়েছে বিশাল নজর কাড়া পাটিগাছের বাগান। এখানে শীতলপাটি, নামাজের পাটি ও আসন পাটি নামে তিন ধরনের পাটি তৈরি করা হয়। পাটির বুনন পদ্ধতি প্রধানত দুই ধরনের। প্রথমত, পাটির জমিনে ‘জো’ তুলে তাতে রঙিন বেতি দিয়ে নকশা তুলে। দ্বিতীয়ত, পাটির জমিন তৈরি হলে তার চতুর্দিকে অন্য রঙের বেতি দিয়ে মুড়ে দিয়ে নকশা তুলে। 

পারিবারিক ও উত্তরাধিকার সূত্রে পাটিকরদের পেশা এগিয়ে চলছে। শৈল্পিক উপস্থাপনায় এবং নির্মাণ কুশলতার কারণে দক্ষ ও সুনিপুণ একজন পাটিয়াল নারীর কদরও রয়েছে সর্বত্র। একটি পাটি বুনতে ৩/৪ জনের দুই তিনদিন সময় লাগে। যা বিক্রি করে পাঁচশো থেকে দেড় হাজার টাকা আসে। মহাজনরা প্রতি পাটিতে একশ থেকে পাঁচশ টাকা লাভ করেন। পাইত্রা চাষ ও কেনার জন্য প্রচুর মূলধন প্রয়োজন হয়। এ জন্য শিল্পীরা মহাজন ও এনজিওদের কাছে হাত পাততে বাধ্য হয়। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি হচ্ছে না। শীতলপাটি শিল্পীর জন্য ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা না থাকায় পুঁজির জন্য শিল্পীরা দাদন ব্যবসায়ী, সুদখোর মহাজনদের কাছে জিম্মি হয়ে থাকেন। তাছাড়া বিদেশে ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত শীতলপাটি রপ্তানিযোগ্য পণ্যের স্বীকৃতি পায়নি।

রাজাপুর উপজেলার পাটি শিল্পী আবা রানী পাটিকর, কৃষ্ণা রানী পাটিকর, জুগল চন্দ্র পাটিকর বলেন, পাইত্রা কাটার পর বেতি আলাদা করার পর বুকার কাজ শুরু। বেতি দিয়ে শীতলপাটি হয়, আর বুকা দিয়ে মূলত পান বাঁধার কাজসহ অন্যান্য কাজ হয়ে থাকে। খেত থেকে কেটে আনা পাইত্রা ছোট করে কেটে বেতি বানিয়ে আলাদা করতে হয়। শীতলপাটি দুই রকম, ফলা ও জোড়া পাটি। ফলা হলো জোড়া ছাড়া শীতলপাটি। পাটির মাঝখানে সমান জোড়া থাকলে তাকে জোড়া বা সপ পাটি বলা হয়। গরমে একটু প্রশান্তির জন্য যুগ যুগ ধরে দেশের মানুষ শীতলপাটি ব্যবহার করে আসছে। আমাদের তৈরি শীতলপাটি দেশ বিদেশে সমাদৃত। দেশের বিভিন্নস্থানে মেলা কিংবা বাজারে বিক্রি হচ্ছে। বিদেশেও যাচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। সংসার চলে এই পাটি বুনিয়ে আমাদের অন্য কোন উপার্জন নেই। শুধু মাত্র শীতলপাটি বিক্রি করেই সংসারের খরচ এবং ছেলেমেয়ের লেখাপড়া চালাই। ৩৫ বছর দরে পাটি বুনাই। তবে শীত মৌসুমে এবং বর্ষার সময় আর্থিক সংকটে ভুগতে হয়। সরকার যদি বিনা সুদে ঋণ প্রদান করতো, তা হলে বেশি পরিমাণে পাইত্রা ক্রয় করে শীতলপাটি তৈরি করা সম্ভব হতো।

বলাই পাটিকর, রিতা রানী পাটিকর, পুতুল পাটিকর বলেন, বাপ দাদার হইছে পাটি বুনতে আছে আমাদের বংশ পাটিকর। বয়স যখন ১০ বছর হেইকাল হইতে পাটি বুনতে আছি, এহন বিয়ে হইছে স্বামী বাড়ি এসে পাটি বুনি। বয়স যত যাব পাটি বুনতে থাকব। আর তো আয়ের কোনো উপায় নেই। পাইত্ররা কেনা লাগে, মোগো খেত নাই। এক কুড়ি পাইত্ররা ৬-৭ হাজার টাকায় কেনা লাগে তারপর পরুষ লোক দিয়া তোলা লাগে। তারপর বেত ছেরা লাগে, সেদ্ধ করে মারে ভিজান লাগে। রৌদ্রে শুকান লাগে হেরপর একটা পাটি তৈরি করতে কমছে কম ৫ দিন সময় লাগে তারপর সেই পাটির দাম কইবে ৮০০ টাকা। পাটি ৫০০ থেকে শুরু করে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত আছে। এতে অনেক খরচ হয় কিন্তু আমাগো লাভ হয় না। সরকার যদি আমাদের বিজিএফ কার্ড করে দিত তাহলে সুবিধা হত।

নলছিটি উপজেলার পাটি শিল্পী তপন পাটিকর, কাজল পাটিকর, চন্দন পাটিকর, সুজন চন্দ্র পাটিকর, পরিবারে একমাত্র আয়ের উৎস হচ্ছে শিতলপাটি বিক্রি আর সেই বিক্রির আয়দিয়েই চলে তাদের পরিবারের ভরণ পোষণ। শিতলপাটি তৈরির কাজ ১২ মাসই কম বেশি থাকে, তবে গরমের মৌসুমে সব চাইতে বেচা বিক্রি বেশি হয়। সেই সময় কাজের চাপ খুব বেশি থাকে। বর্তমানে শীতলপাটির বাজার মোটামুটি ভালো। তবে পাটি তৈরি করতে একজন লোকের ২ থেকে ৩ দিন সময় লেগে যায়, সে তুলনায় মজুরি কম পরে যায়। প্রকারভেদে প্রতিটি শীতলপাটির দাম ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত পাইকারি বিক্রি হয়ে থাকে। তাতে করে একজন পাটিকর বছরে ১ লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করে থাকে।

রাজাপুরের আশার আলো শীতল পাটি উন্নয়ন প্রকল্প সমিতির সভাপতি অবিনাশ চন্দ্র পাটিকর বলেন, সিডরের সময় সেনাবাহিনী ৪ লাখ টাকা দিয়ে দুইটা ঘর তৈরি করে দিছে। গরমের সময় সবাই সেখানে বসে পাটি তৈরি করে। বর্তমানে ঘর দুটি নাজুক আর বেহাল দশা। যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে পরে যেতে পারে। সরকার যদি ঘর দুইটা নতুন করে নির্মাণ করে দেয় তাহলে আমরা ওখানে কাজ করতে পারতাম। সমিতির সামনের মাঠে বর্ষাকালে বেতি শুকানো যায় না পানিতে বেতি নষ্ট হয়ে যায়। সরকারিভাবে বালু দিয়ে মাঠ ভরাট করে দিলে বেতি শুকানো যেত। আমরা সরকারি কোনো সহযোগিতা পাই না। যদি পেতাম তাহলে খেয়ে পরে বাঁচতে পারতাম। 

নলছিটির শীতল পাটি শিল্প যুব ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক বাবুল দত্ত বলেন, ঢাকা ইসলামী ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে শীতল পাটির মান-উন্নয়নের জন্য পাটিকরদের ৩টা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটা ব্যাচে ৩০ জন করে পাটিকর প্রশিক্ষণ নিয়েছে। তবে আজ পর্যন্ত আমাদের জেলা থেকে সরকারিভাবে কোনো সহয়তা করা হয়নি। ডিসি অফিসে একাধিক বার আবেদন করেও সহয়তা পায়নি। কিছু দিন আগে ঝালকাঠি জেলা প্রশাসক ফারাহ গুল নিঝুম স্যার আমাদের এখানে পরিদর্শনে এসেছিল তখন তিনি ফাউন্ডেশন দেখে বলেন ছাউনি দেওয়া হয়নি কেন? আমি বলি স্যার ফাউন্ডেশনর কোনো টাকা নেই। তখন তিনি বলেন, টিন যা লাগে আমি দেব এবং তিন টন চাল দেব। আমাদের ওখানে বসে মুখে বলে আসছে ওই পর্যন্ত কিন্তু তিনি আর কোনো সহযোগিতা করেননি। পরে যোগাযোগ করেছি। তিনি বলেন, পরে দেখা যাবে। আমার এলাকার লোকজন মনে করে স্যার যখন বলে গেছে তখন অবশ্যই দেবে। এখন তারা মনে করে ওই বরাদ্দ আমি উঠিয়ে নিয়েছি।

ঝালকাঠি জেলা প্রশাসক ফারাহ গুল নিঝুম বলেন, ঝালকাঠির শীতল পাটি একটি ‘ব্র্যান্ড পণ্য’। পাটি প্রসারে পাটিকরদের প্রশিক্ষণসহ নানা রকম সুযোগ সুবিধা দেওয়ার উদ্যোগ চলছে। তারপরও আমরা তাদের কাছে যাব। তাদের সব সমস্যার কথা শুনব এবং সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করব।

ঝালকাঠির ‘ব্র্যান্ড পণ্য’ শীতল পাটিকে তুলে ধরতে সরকারিভাবেই বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

আরকে