ঠাকুরগাঁও শহরের প্রাণকেন্দ্রে ‘কেএমবি ব্রিকস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সরকারি বিধিনিষেধ অমান্য ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই সম্পূর্ণ অনুমোদনহীনভাবে ইটভাটা পরিচালনাসহ ইট পোড়ানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয় সচেতন মহল পরিবেশ দূষণ রোধসহ এই ভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসন, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটসহ পরিবেশ অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগও দিলেও অজ্ঞাত কারণে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

জানা গেছে, সদর উপজেলার ইয়াকুবপুরে ‘কেএমবি ব্রিকস’ ঘেঁষে ১১৭নং বরুনাগাঁও ইয়াকুবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং আবুল হোসেন মহাবিদ্যালয় রয়েছে। ভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়া চারপাশ ছড়িয়ে পড়ায় পরিবেশের দূষণ দিন দিন বাড়ছেই। এতে কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীদের অনেকেই শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যাসহ বিভিন্ন রোগে প্রায়ই অসুস্থ হচ্ছে। দীর্ঘদিনেও অনুমোদনহীন ইটভাটাটি বন্ধ না হওয়ায় সচেতন অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের অন্যত্র ভর্তি করছেন। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুটিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন কমে আসার পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে সেখানকার শিক্ষার পরিবেশ।

স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ)-২০১৩ এবং ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ)-২০১৯ সালের প্রকাশিত গেজেট-এর বিধান অনুযায়ী ‘কেএমবি ব্রিকস’ স্থাপন করা হয়নি। এমনকি ইটভাটাটির পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো ছাড়পত্রও নেই। সরকারি বিধিমালা তোয়াক্কা না করে সম্পূর্ণ বেআইনি ও অবৈধ উপায়ে ইটভাটার মালিক মোশারুল হক তার ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। যদিও সরকার ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ)-২০১৩ এবং ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ)-২০১৯ গেজেট এর মাধ্যমে ফিক্সড ভাটা নিষিদ্ধ করেছে। তারপরও কীভাবে বা কোন উপায়ে মোশারুল হক ফিক্সড ভাটা পরিচালনা করছেন তা নিয়ে অনেকেই প্রশাসনের দিকে আঙুল তুলেছেন।

এ ব্যাপারে বরুনাগাঁও ইয়াকুবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শিউলি বেগমকে কল করা হলে তিনি ব্যস্ত আছেন জানিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

বিদ্যালয়টির ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আতাউর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা অনেক দিন ধরে ইটভাটাটি বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে আসছি। কিন্তু আজও ইটভাটাটি বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। যখন ইট পোড়ানো হয় তখন চারপাশের পরিবেশ ভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকে। মাঝেমধ্যে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এভাবে চলতে থাকায় প্রতি বছরই এই বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা অন্যত্র ভর্তি হচ্ছে।

বরুনাগাঁও ইয়াকুবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শহরের ইয়াকুবপুর গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা ঢাকা পোস্টকে জানান, ২০১৭-২০১৮ সালে ঠাকুরগাঁও জেলায় ৮টি ফিক্সড ইটভাটা ভেঙে দেওয়া হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে ‘কেএমবি ব্রিকস’ ফিক্সড ভাটাটি ভাঙা হয়নি। কেএমবি ইটভাটার মালিক মোশারুল হক কারও মদদে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে স্থানীয় প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যাচ্ছেন। গত বছরের ১৫ নভেম্বর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে এ সংক্রান্ত একটি লিগ্যাল নোটিশও দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয়রা আরও জানান, গত বছর পরিবেশ অধিদপ্তরের পঞ্চগড় জেলা কার্যালয় (স্মারক নং ২২.০২,৭৭০০,৪৩৫,২৭.০০৪,২২-৫৮২) ‘কেএমবি ব্রিকস’ ইটভাটাটির অবকাঠামো অপসারণের লক্ষ্যে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ প্রসঙ্গে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর প্রতিবেদন দাখিল করে। কিন্তু এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় ইটভাটার মালিক মোশারুল হক উৎপাদন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। অথচ পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ‘কেএমবি ব্রিকস’ ইটভাটাটি ১২০ ফুট স্থায়ী চিমনি বিশিষ্ট সনাতন পদ্ধতির ইটভাটা, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ (সংশোধিত ২০১৯) অনুসারে ইটভাটাটির অনুকূলে ছাড়পত্র প্রদানের কোনো সুযোগ নেই।

কথা হয় অ্যাডভোকেট নাজমুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষকে আইনি সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি পরিবেশ ও প্রকৃতি নিয়ে কাজ করছেন। নাজমুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইটভাটাটির চিমনি থেকে ৫৮০ মিটার দূরে বরুনাগাঁও ইয়াকুবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির অবস্থান। আইনের ৮(৩)(ঙ) ধারা মোতাবেক ইটভাটাটির অবস্থান গ্রহণযোগ্য নয়। এ ছাড়া মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রিট পিটিশন নং-১৩৪১৬/২০২২ এর আদেশে জেলার অবৈধ সকল ইটভাটা অপসারণের লক্ষ্যে জেলা প্রশাসনকে আদেশ প্রদান করা হয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে ‘কেএমবি ব্রিকস’ ইটভাটাটির সকল অবকাঠামো অপসারণে একজন বিজ্ঞ এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের জন্য অনুরোধ করা হলেও আজও কোনো ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ হয়নি। ‘কেএমবি ব্রিকস’ পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। এ ধরনের পরিবেশ দূষণকারী ইটভাটার বিরুদ্ধে প্রশাসনের নীরবতার কারণে জনমনে নানা ধরনের নেতিবাচক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আমরা চাই পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষাসহ কোমলমতি শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য-শিক্ষা নিশ্চিতকরণে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হোক।

এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ‘কেএমবি ব্রিকস’ ইটভাটার মালিক মোশারুল হক প্রথমে সরাসরি দেখা করতে প্রস্তাব দেন। পরে অনুমোদন ছাড়া ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপনের অভিযোগ এড়িয়ে গিয়ে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি নিয়ম মেনেই ভাটা পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়েছি। আমার মতো অনেকেই এভাবে ইটভাটা পরিচালনা করছেন। আর বিদ্যালয় থেকে ইটভাটাটি অনেক দূরে, এ কারণে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

এ বিষয়ে সালন্দর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলে ইলাহী মুকুট চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বরুনাগাঁও ইয়াকুবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে একটি ইটভাটা রয়েছে। তবে ভাটার ধোঁয়া থেকে পরিবেশ দূষণ হয় কি না আমার জানা নেই। আমাকে কেউ কোনো অভিযোগও করেনি। বিদ্যালয়ের বাচ্চাদের অসুস্থতার বিষয়টি জানতে আমি খোঁজ নেব।

পরিবেশ অধিদপ্তর রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক সৈয়দ ফরহাদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি দুই মাস রংপুরের বাইরে ছিলাম। গতকাল অফিসে ফিরেছি। যদি কেউ অভিযোগ দিয়ে থাকে তাহলে তদন্তসাপেক্ষে ওই ইটভাটার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় পরিবেশ দূষণ নিয়ে যদি কারও অভিযোগ থাকে তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে আগে অভিযোগটি খতিয়ে দেখা হবে।

এমজেইউ