তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। কারও হাতে পলো, কারও হাতে জাল। আশপাশের বিভিন্ন উপজেলা থেকে বিলের ধারে জড়ো হয় হাজারো মানুষ। ভোরের আলো ফুটতেই শিশু থেকে শুরু করে নানা বয়সী মানুষ মাছ ধরার উপকরণ নিয়ে বিলের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মাছ ধরার এই উৎসব যেন মিলনমেলায় রূপ নেয়। 

কেউ ঠান্ডায় জবুথবু অবস্থা। আবার কেউ মাছ ধরতে পেরে আনন্দ উল্লাস করছেন। যদিও প্রত্যাশা অনুযায়ী মাছ না পাওয়ায় বাউৎ উৎসবের এ হাসি শেষ পর্যন্ত অনেকের মুখেই দেখা যায়নি।

মঙ্গলবার (২৮ নভেম্বর) সকালে পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার পার-ভাঙ্গুড়া ইউনিয়নের ওই বিলে মাছ ধরতে নেমেছিলেন কৃষক, শ্রমিক, চাকরিজীবী-ব্যবসায়ী, চিকিৎসকসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার কয়েক হাজার মানুষ।

বিলে গিয়ে দেখা গেছে, মাছ ধরতে নেমেছে আশপাশের ২০ থেকে ২৫ গ্রাম থেকে আসা বাসিন্দারা। টাঙ্গাইল, রাজশাহী, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, নঁওগা, কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা শৌখিন মাছ শিকারিরা বাস-মিনিবাস, ট্রাক-মিনিট্রাক, করিমন-নসিমন, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাসহ বিভিন্ন যানবাহন নিয়ে এসেছেন। সকালের শুরুতে মাছ শিকারিদের উৎসাহ দেখে মনে হওয়ার উপায় ছিল না উৎসবে কোনো পরিবর্তন এসেছে। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাটা পড়ে উৎসবে। কীটনাশক ট্যাবলেট ব্যবহার করে আগের দিন মাছ নিধন করা হয়েছে। ফলে অনেক মাছ মরে ভেসে উঠে। এতে অনেকেই মাছ না পেয়ে হতাশা প্রকাশ করেন। 

বেশ কয়েকজন মাছ শিকারির সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, বর্ষার পর পানি নিচু এলাকাগুলোতে নেমে যায়। ফলে সেখানে প্রচুর মাছ জমে। প্রতি বছরে এ সময়ে বিলপাড়ের বাসিন্দারা একত্র হয়ে মাছ শিকারে নামেন। আগে বিলে নেমে কেউ কোনো দিন খালি হাতে ফেরেনি। বড় বড় রুই, কাতলা, বোয়াল, চিতল, শোল ও গজার মাছ পর্যাপ্ত পাওয়া যেত। উৎসব হতো টানা কয়েকদিন ধরে। কিন্তু এবার বিলে মাছের পরিমাণ কমে গেছে। ফলে উৎসব আর আগের মতো হয় না। এখন সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার আয়োজন করা হয়।  

পাবনার কুচিয়ামোড়ার শাখাড়িপাড়ার আব্দুস সাত্তার জানান, ছোটবেলা থেকে এই বিলের বাউৎ উৎসব শুরু হলেই তিনি ছুটে আসতেন মাছ ধরতে। মাছ ধরতে এসে তিনি কখনো নিরাশ হননি। রুহুল বিলে নামলে তিনি মাছ না নিয়ে কখনো বাড়ি ফিরেছেন এমন ঘটনা ঘটেনি। পলো দিয়ে তিনি ৫ কেজি চিতল পেয়েছিলেন। এবার সেই আশায় তিনি পলো চালিয়ে যাচ্ছেন।

মাছ ধরতে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল থেকে এসেছেন মো. সবুর হোসেন মিয়া। তিনি বলেন, আমরা প্রায় ১০-১৫টি বাস-মিনিবাস নিয়ে গতকাল পাবনার ভাঙ্গুড়ার রুহুল বিল এলাকায় অবস্থান করেছি। ভোরে বিলের মধ্যে আমরা পলো, ধর্মজাল, চাকজাল, ঠেলাজাল, খুইরা জাল, বাদাই জালসহ মাছ ধরার উপকরণ নিয়ে বিলে নামি। অনেক আশা নিয়েই এখানে এসেছি। কিন্তু বিলের পানিতে নেমে দেখি কোনো মাছ নাই। তাই হতাশ হয়ে বাড়ি ফেরা ছাড়া উপায় নেই।

রাজশাহী থেকে আসা মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, আমরা কয়েকটি বাস নিয়ে রাত ২টার দিকে এখানে  এসে অবস্থান করি মাছ শিকার করার জন্য। প্রতিবছরই এখানে আমরা আসি। কিন্তু এ বছর কেউ তেমন মাছ পায়নি। বাড়িতে গেলে মানুষজন রাগ করবে ভেবে বাজার থেকে মাছ কিনে নিয়ে যেতে হবে। ইজারা না দিয়ে সরকার এটা সবার জন্য উন্মোক্ত করে দিলে সবার জন্যই ভালো হতো।

ভাঙ্গুড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. নাজমূল হুদা বলেন, ভাঙ্গুড়ার রুহুল বিলে প্রতিবছরই মাছ ধরার উৎসব হয়ে থাকে। প্রতিবার আমরা সেখানে অংশগ্রহণ করে থাকি। এ বছর আমরা বিষয়টি জানিই না। এটা একদিকে যেমন আনন্দ উৎসব অন্যদিকে বিলের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। কারণ একসঙ্গে এত মানুষ পানিতে নামলে পানি দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। আবার মাছেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়। মা মাছ, পোনা মাছ সব কিছু ধ্বংস হয়ে যায়। উৎসবের জন্য দেশীয় মাছ কমে যাচ্ছে। দেশীয় মাছ রক্ষার্থে আমরা দুয়ারি, সুতিজালসহ নানা কিছু বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছি। মাছের অভয়ারণ্য হিসাবে খ্যাত এই অঞ্চলের নির্ধারিত সীমারেখায় কোনো মানুষ অসাধু প্রক্রিয়ায় যাতে মাছ ধরতে না পারেন সে বিষয়ে প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।

রাকিব হাসনাত/এএএ