অষ্টগ্রামের পনিরের প্রশংসা বঙ্গভবন ও গণভবনেও
কিশোরগঞ্জ জেলার হাওর উপজেলার অষ্টগ্রামের সুস্বাদু-মুখরোচক খাবার হচ্ছে পনির। গরু ও মহিষের দুধের তৈরি এ পনির মোগল দরবার থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের সরকারপ্রধানদের পছন্দের তালিকা দখল করে আন্তর্জাতিক মর্যাদাও অর্জন করেছে।
তবে পশ্চাৎপদ হাওর জনপদ অষ্টগ্রামের মধ্যযুগীয় যোগাযোগব্যবস্থা পানির রফতানির ক্ষেত্রে বড় ধরনের বাধা হয়ে দেখা দিয়েছিল। এবার এ উপজেলাটি অলওয়েদার সড়কপথের আওতায় এসেছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও ব্র্যান্ডিং পণ্য হিসেবে গণ্য হয়েছে অষ্টগ্রামের পনির।
তবে স্থানীয় প্রশাসন এবার দেশব্যাপী এ পনির কর্নার তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছে। অষ্টগ্রামে তৈরি বিখ্যাত পনিরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে দেশ-বিদেশে রফতানির সুযোগ এসেছে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিজ্ঞাপন
২০২০ সালের ৮ অক্টোবর গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি হাওর উপজেলা ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামের সঙ্গে যুক্ত অলওয়েদার সড়কের উদ্বোধন করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী অষ্টগ্রামের এ প্রসিদ্ধ পনিরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। তিনি বিদেশে কিশোরগঞ্জের পনির রফতানির অপার সম্ভাবনার কথাও বলেন।
জানা গেছে, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বৃহত্তর হাওরাঞ্চলের ‘গেটওয়ে’ হিসেবে পরিচিত কিশোরগঞ্জ জেলার হাওর জনপদ অষ্টগ্রামের পনিরের খ্যাতি ও প্রসিদ্ধি পাঁচ শতাধিক বছরের ঐতিহ্যে লালিত।
অষ্টগ্রামের কাস্তুলে মোগল সম্রাটের অধস্তন একটি দল এসে ছাউনি গড়ে। তারা এখানে গরু ও মহিষের প্রচুর বাথান দেখে মুগ্ধ হয়। তাদেরই একজন প্রথমে গরু ও মহিষের দুধ দিয়ে এ মুখরোচক সুস্বাদু খাবার পনির তৈরি করেন।
মোগল দরবারেও নিয়মিত পাঠানো হতো অষ্টগ্রামের এ পনির। আর তাদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে এ এলাকার মানুষ ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পনির তৈরির কাজ শুরু করে। দিনে দিনে এ পনিরের খ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। পনির তৈরি করে জীবিকা নির্বাহের পথ খুঁজে পান এ এলাকার অসংখ্য মানুষ।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এ হাওর জনপদের সন্তান হওয়ার সুবাদে এবার মোগল দরবারের পর বঙ্গভবন, গণভবন এমনকি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনেও ঠাঁই পায় অষ্টগ্রামের পনির।
অষ্টগ্রামের তৈরি দেশ-বিদেশের মানুষের প্রিয় খাদ্যতালিকায় স্থান পেলেও অনুন্নত ও মধ্যযুগীয় যোগাযোগব্যবস্থার কারণে এখানকার তৈরি পনির দেশ-বিদেশে সেভাবে রফতানির কথা কখনো চিন্তাও করতে পারেননি পনির কারখানার মালিকরা। যে কারণে আশপাশের এলাকা এবং রাজধানী ঢাকা শহরের মধ্যেই সীমিত ছিল এর বিপণন।
এবার সরকার ৮৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে অষ্টগ্রাম, ইটনা ও মিঠামইন হাওর উপজেলায় দৃষ্টিনন্দন অলওয়েদার সড়কপথ নির্মাণ করায় সুযোগ এসেছে দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেশের অন্যান্য স্থানের সঙ্গে যোগাযোগের। নতুন এ সড়কপথ এখন অষ্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী প্রসিদ্ধ পনির দেশ-বিদেশে রফতানির নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে।
এ ছাড়া এ অঞ্চলের অতিথি আপ্যায়নে গরম ভাতের সঙ্গে দেওয়া হয় কুচি কুচি করে কাটা পনির। আর ভাপ ওঠা চিতই পিঠার ওপরি ভাগে পনিরের টুকরো দিয়ে দিলে হয় অতুলনীয়।
অবশ্য, বর্তমান প্রজন্মের সঙ্গে পনিরের পরিচয় ভিন্নভাবে। পিৎজা, বার্গারসহ হরেক রকম বিস্কুটে পনির ব্যবহার হয়ে থাকে। এ ছাড়া সমুচা, পরোটা বা সালাদেও পনির দেওয়ার রীতি দীর্ঘদিনের।
পনির তৈরির কারখানার মালিক নিশান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন পনিরের চাহিদা অনেক। এর মধ্যে কিছু ভোক্তার প্রধান আগ্রহ অষ্টগ্রামের পনিরে। কারণ, আমাদের পনির জিবে জল আনে। বিশেষ করে দেশের কিছু ভিআইপির আকর্ষণীয় নজর আছে আমাদের পনিরের দিকে। ভারতেও এ পনিরের চাহিদা বাড়ছে। ফলে অনেক সময় চাহিদার বিপরীতে জোগান দিতে কষ্ট হয়।
অষ্টগ্রামের পনিরের বিশেষত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি জানান, এখানকার গরু ও মহিষ বছরের বেশির ভাগ সময় সতেজ ঘাস খাওয়ার সুযোগ পায়। সেই দুধের কারণে ক্রিম থাকে প্রচুর। ফলে পনির তৈরির পর সুন্দর রং আসে এবং স্বাদেও ভিন্নতা থাকে।
এক কেজি পনির তৈরি করতে ১০ কেজি দুধের প্রয়োজন হয়। হাঁড়িতে দুধ গরম করে ছানা করা এবং ছেঁকে পনির তৈরি করতে হয়। সব মিলিয়ে উৎপাদন খরচ হয় ৬০০ টাকার মতো। ফলে ৭০০ টাকার নিচে বিক্রি করার সুযোগ থাকে না। কখনো কখনো ১০০০ বা ১২০০ টাকা কেজিদরে বিক্রি করা হয়।
ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ অষ্টগ্রামে উৎপাদিত পনিরের প্রধান বাজার। এখন অনলাইনেও বাজারের প্রসার হচ্ছে। অনলাইন ও মোবাইলে ফোনে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে অর্ডার আসে বলেও জানান নিশান।
অষ্টগ্রাম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শহীদুল ইসলাম জেমস ঢাকা পোস্টকে জানান, অষ্টগ্রামের পনিরের নাম সারাদেশে ছড়িয়ে আছে। তাই যে কেউ অষ্টগ্রামে এলে একবার হলেও এ পনিরের স্বাদ নিতে চান।
অষ্টগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রফিকুল আলম জানান, পনিরকে ব্র্যান্ডিং পণ্যের আওতায় আনার জন্য দেশব্যাপী পনির কর্নার তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। এতে এ খাতে উৎপাদনকারীরা আরও বেশি লাভবান হবেন।
কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম) আসনের সংসদ সদস্য ও রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বড় ছেলে রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, অষ্টগ্রামের পনির অনেক সুস্বাদু। বঙ্গভবন ও গণভবনের এমনকি দেশের বাইরে থেকেও যারা রাষ্ট্রীয় অতিথি আসেন, তারাও অষ্টগ্রামের পনিরের অনেক প্রশংসা করেন।
তিনি আরও বলেন, অলওয়েদার সড়ক হওয়ায় পনিরকে জেলার ব্র্যান্ডিং পণ্য হিসেবে দেশে-বিদেশে বাণিজ্যিকভাবে পাঠানোর সুযোগ হচ্ছে। পনির উৎপাদনে হাওরের জনগণ অর্থনৈতিকভাবে এখন আরও লাভবান হতে পারবেন।
এনএ