যেভাবে গ্রাম থেকে বন্দর হয়ে উঠল বেনাপোল
দেশ স্বাধীনের পর বেনাপোল গ্রামটি ছিল অজপাড়াগাঁ। কৃষি ও দিনমজুরি ছিল গ্রামের মানুষের জীবন-জীবিকার মাধ্যম। সময়ের পরিবর্তনে বেনাপোল এখন স্থলবন্দর। আমদানি-রফতানির সবচেয়ে বড় রুট। বছরে ভারতে ৪০ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি ও আট হাজার কোটি টাকার পণ্য রফতানি হয়। বদলে গেছে মানুষের জীবন। হয়েছে অবকাঠামোর উন্নয়ন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যশোরের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান উৎস বেনাপোল স্থলবন্দর। শার্শা উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম বেনাপোলে এটির অবস্থান। ভারত-বাংলাদেশের সিংহভাগ বাণিজ্য বন্দর দিয়ে হয়। প্রতি বছর বন্দর থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পায় সরকার। দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে যেমন বন্দরটি বড় ভূমিকা পালন করছে তেমনি বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
জানা যায়, ১৯৭৮ সালের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশ ওয়্যারহাউস করপোরেশনের অধীনে বেনাপোল স্থলবন্দরের যাত্রা শুরু। ১৯৭৯ সালের ৬ আগস্ট ওয়্যারহাউসকে শুল্ক স্টেশন ঘোষণা করা হয়। ২০০২ সালে বেনাপোল শুল্ক স্টেশনকে স্থলবন্দর করা হয়। পরে এটি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় চলে আসে।
বন্দরের শুল্ক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রয়েছে কাস্টমস হাউস। স্থলবন্দরের কার্যক্রম পরিচালনা করে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ। যোগাযোগব্যবস্থা সহজ হওয়ায় দিন দিন বন্দর দিয়ে দু’দেশের ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যের আগ্রহ বাড়তে শুরু করে। রেলপথেও শুরু হয় বাণিজ্য। বাণিজ্যিক চাহিদা বাড়ায় ধীরে ধীরে বন্দরের অবকাঠামো বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার স্থল বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে বেনাপোল বন্দর ব্যবহার হয়। বেনাপোল থেকে কলকাতার দূরত্ব ৮০ কিলোমিটার। বাংলাদেশ থেকে স্থলপথেও ভারত যাওয়া যায়। যশোর-বেনাপোল-বনগাঁ-কলকাতা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড দিয়ে প্রতিদিন শত শত মানুষ চলাচল করে। বন্দরের রেলস্টেশন দিয়ে বাংলাদেশ-ভারতে চলে ট্রেন।
বেনাপোল স্থলবন্দরে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য পরিচালনার জন্য ৩৮টি ওয়্যারহাউস, একটি ট্রান্সশিপমেন্ট ইয়ার্ড, তিনটি ওপেন ইয়ার্ড, একটি ভারতীয় ট্রাক টার্মিনাল, একটি রফতানি ট্রাক টার্মিনাল ও ২৫ একর জায়গায় একটি ট্রাক চেচিস টার্মিনাল রয়েছে। বন্দরের আয়াতন ৯০ একর। বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত কাস্টমস, বন্দর, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও শ্রমিক মিলে প্রায় ২০ হাজার মানুষ। পাশাপাশি লক্ষাধিক শ্রমজীবীর কর্মসংস্থান হয়েছে।
তবে বন্দরের অবকাঠামোর উন্নয়ন হলেও শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো এবং চিকিৎসাসেবার জন্য হাসপাতাল নির্মাণের দাবি জানালেও বাস্তবায়ন হয়নি।
যেভাবে যাবেন: যশোর থেকে গাড়ি, বাস অথবা সিএনজি অটোরিকশাযোগে শার্শা উপজেলায়। শার্শায় বেনাপোল বন্দর। বন্দর দিয়ে ভারতে যাওয়া যায়।
বন্দরশ্রমিক একসের আলী মন্ডল বলেন, প্রায় ২০ বছর ধরে বন্দরে কাজ করছি। যা মজুরি পাই তাতে সংসার চলে। যখন বন্দরে কাজ করতাম না, তখন অভাব-অনটনের মধ্যে সংসার চলত। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারতাম না। কিন্তু এখন অনেক ভালো আছি।
বন্দরের আরেক শ্রমিক বাবলুর রহমান বলেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বন্দরে ২৪ ঘণ্টা কাজ করি। তবে ভালো আছি। বর্তমান বাজার অনুযায়ী যে মজুরি হওয়ার কথা, তা পাই না। আমাদের মজুরির বিষয়টি বিবেচনা করা দরকার।
বেনাপোল পৌরসভার কমিশনার আব্দুল জব্বার বলেন, বন্দরের কারণে একসময়ের অজপাড়াগাঁ এখন শহর। অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল এখানের মানুষ। দিন দিন বাড়ছে শিক্ষার হার। হচ্ছে অবকাঠামোর উন্নয়ন।
বেনাপোল হ্যান্ডলিং শ্রমিক ইউনিয়নের সেক্রেটারি ওহিদুল ইসলাম বলেন, দেশের অন্যান্য বন্দরের চেয়ে বেনাপোল বন্দরে শ্রমিকদের মজুরি সবচেয়ে কম। অথচ শ্রমিকরা করোনাকালীন রাত-দিন কাজ করছেন। শ্রমমূল্য বাড়ানোর জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় সংসদ সদস্য ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাজে অনুরোধ জানিয়েছেন শ্রমিকরা।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, বন্দরে পণ্য খালাসের কাজ করতে গিয়ে অনেক শ্রমিক গুরুতর আহত হন। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার মানুষ বন্দরে কাজ করে। তাদের স্বাস্থ্যসেবায় একটি হাসপাতাল নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের। এটি আজও বাস্তবায়ন হয়নি।
বেনাপোল রেলস্টেশনের মাস্টার সাইদুর রহমান বলেন, বেনাপোল বন্দরের গুরুত্ব বাড়ায় এখন স্থলপথের পাশাপাশি রেলপথেও পাল্লা দিয়ে ভারত থেকে পণ্য আমদানি হয়। সেই সঙ্গে রফতানিও হয়। এতে সরকারের যেমন রাজস্ব আসছে তেমনি মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে।
বেনাপোল বন্দরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আব্দুল জলিল বলেন, বন্দরের প্রধান চালিকাশক্তি শ্রমিক। তাদের নায্য দাবি যাতে বাস্তবায়ন হয়, সেজন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।
এএম