বজ্রপাতে স্বামী সবুজ মিয়াকে হারিয়ে দিনমজুরি করে সংসার চালান হারুনা আক্তার, পাশে দুই সন্তান

২০২০ সালে নেত্রকোনায় বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছেন ১০ জন। তাদের অধিকাংশই হতদরিদ্র। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে দুঃখ-কষ্টে জীবনযাপন করছেন স্বজনরা। অনেক পরিবারের হাল ধরেছেন নারীরা। তাদের কেউ পরের বাড়িতে দিনমজুরি করে সংসার চালাচ্ছেন, আবার কেউ শিশুসন্তানসহ আশ্রয় নিয়েছেন বাবার বাড়িতে। প্রতিটি পরিবারের সদস্যরা কাটাচ্ছেন দুর্বিষহ জীবন। 

বজ্রপাতে নিহত ব্যক্তিদের কারো কারো পরিবার সরকারিভাবে ১০ হাজার কিংবা ২০ হাজার টাকা করে এককালীন আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। তবে অনেকে সেই টাকাও পাননি। এর বাইরে আর কোনো ধরনের সরকারি-বেসরকারি সহায়তা পাননি তারা। 

কেন্দুয়া উপজেলার কান্দিউড়া ইউনিয়নের বেজগাতী গ্রামের হারুনা আক্তার (৪০) জানান, তার স্বামী দিনমজুর সবুজ মিয়া ২০২০ সালের ২০ আগস্ট হাওরে কাজ করতে গিয়ে বজ্রপাতে প্রাণ হারান। বসতভিটা এবং দুই ছেলে ও এক মেয়ে রেখে যান সবুজ মিয়া। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে চরম হতাশায় পড়েন হারুনা। কীভাবে সংসার চালাবেন তা ভেবে পাচ্ছিলেন না। একপর্যায়ে অন্যের বাড়িতে দিনমজুরির কাজ শুরু করেন তিনি। 

হারুনা আক্তার বলেন, কেউ আমাদের খোঁজ নেয় না। মেয়েটা পড়াশোনা করত। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর বর্তমানে তার লেখাপড়া বন্ধ। মেয়েটাকে বিয়ে দেওয়ারও বয়স হয়েছে। টাকার অভাবে বিয়ে দিতে পারছি না। ছেলে দুটো লেখাপড়া করে না। বড় ছেলে কাজ করতে পারে। তবে ছোট ছেলে এখনো কাজ করতে পারে না। আমি সরকারিভাবে কোনো সহায়তা পাইনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কান্দিউড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহীদুল্লাহ কায়সার ঢাকা পোস্টকে বলেন, হারুনা আক্তার খুবই অসহায়। সন্তানদের নিয়ে খুব কষ্টে আছেন। কিন্তু আমাদের তো তেমন কিছু করার নেই। আমরা পরিষদের পক্ষ থেকে হারুনা আক্তারকে একটি বিধবা ভাতার কার্ড করে দিয়েছি। তাকে সরকারি ঘর দেওয়ার চেষ্টা করব।

২০২০ সালের ৩১ আগস্ট হাওরে ফসলি জমি চাষ করতে গিয়ে বজ্রপাতে মারা যান কেন্দুয়া উপজেলার নওপাড়া ইউনিয়নের কুতুবপুর বিলপাড়া গ্রামের কৃষক আবুল কাশেমের ছেলে মনির মিয়া (২০)। মনির ছিলেন আবুল কাশেমের আট সদস্যের সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। মনিরের মৃত্যুতে চরম বিপাকে পড়ে কাশেমের সংসার।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে আবুল কাশেম বলেন, আমার তিন ছেলে এবং তিন মেয়ের মধ্যে মনির ছিল উপার্জনক্ষম। অন্যরা ছোট ছোট। মনিরই সংসার চালাত। কিন্তু বজ্রপাতে হঠাৎ ছেলেটি মারা গেল। তারপর থেকে আমরা খুব কষ্টের মধ্যে আছি। মনিরের মৃত্যুর পর সরকারিভাবে ১০ হাজার টাকা সহায়তা পেয়েছিলাম। অন্য কেউ আজ পর্যন্ত আমাদের খবর নেয়নি।

মদন উপজেলার গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের রাজালিকান্দা গ্রামের মঞ্জুরুল হকের ছেলে ইয়াহিয়া (৩০) হাওরে ধান কাটতে গিয়ে ২০২০ সালের ১৮ এপ্রিল বজ্রপাতে মারা যান। ইয়াহিয়ার মৃত্যুতে দুই বছরের কন্যাসন্তান নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন স্ত্রী চায়না আক্তার। তিনি কিছুদিন স্বামীর বাড়িতে অবস্থানের পর সন্তান নিয়ে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেন। বর্তমানে সেখানে নানা দুঃখ-কষ্টে দিনাতিপাত করছেন।

ইয়াহিয়ার ছোট ভাই মোহাম্মদ জয় মিয়া বলেন, আমি গরিব মানুষ। পরের বাড়িতে কাজ করে খাই। তবু ভাইয়ের মৃত্যুর পর ভাবি এবং ভাতিজিকে যতটুকু পারি সহায়তা করছি। কিন্তু ভাবি নিজের ইচ্ছায় বাবার বাড়িতে চলে গেছেন। আমি মাঝেমধ্যে তাদের খোঁজখবর নিই।

গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মো. সাদেক মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইয়াহিয়া খুব গরিব মানুষ ছিলেন। বজ্রপাতে মারা যাওয়ার পর শিশুসন্তান নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে গেছেন স্ত্রী। এলাকায় থাকলে আমি সাধ্যমতো সহযোগিতা করতাম।

২০২০ সালে নেত্রকোনায় বজ্রপাতে ১০ জনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেলেও জেলা দুর্যোগ ও ত্রাণ কর্মকর্তার কার্যালয়ে বজ্রপাতে আটজনের মৃত্যুর হিসাব আছে।  

এ তালিকা অনুযায়ী ১৩ সেপ্টেম্বর দুর্গাপুর উপজেলার চন্ডিগড় ইউনিয়নের কেরনখলা গ্রামের কৃষক শফিকুল ইসলাম (২৮), ২৬ সেপ্টেম্বর কুল্লাগড়া ইউনিয়নের ভুলিপাড়া গ্রামের স্কুলছাত্রী মুক্তা আক্তার (১৩), ১৮ এপ্রিল মদন উপজেলার গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের রাজালিকান্দা গ্রামের দিনমজুর ইয়াহিয়া (৩০) ও শিশু রায়হান (১০), ১৪ মে কলমাকান্দা উপজেলার কৈলাটি ইউনিয়নের পাইপুকুরিয়া গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম (২৬), ৩ আগস্ট পূর্বধলা উপজেলার আগিয়া ইউনিয়নের মহিষবেড় গ্রামের কৃষক আলাল উদ্দিন (৪১) ও বিশকাকুনী ইউনিয়নের ধলা গ্রামের কৃষক মাহফুজ আলীম (২৫) এবং ১০ আগস্ট বারহাট্টা উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের চল্লিশ কাহনিয়া গ্রামের কৃষক ইসলাম উদ্দিন (৪৫) বজ্রপাতে মারা যান।

তবে এ তালিকায় নেই দিনমজুর সবুজ মিয়া ও কৃষক মনির মিয়ার নাম।

জানতে চাইলে নেত্রকোনা জেলা দুর্যোগ ও ত্রাণ কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের তালিকা অনুযায়ী ২০২০ সালে জেলায় বজ্রপাতে আটজনের মৃত্যু হয়েছে। এর বেশি আমাদের জানা নেই। বেশি হলেও হতে পারে। 

বজ্রপাত বৃদ্ধির কারণ এবং প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইনডিজেনাস নলেজের (বারসিক) নেত্রকোনা অঞ্চলের সমন্বয়কারী অহিদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, অধিক উচ্চতাসম্পন্ন বৃক্ষ যেমন তালগাছ ও নারকেল গাছ কমে যাওয়া, ধাতব পদার্থ যেমন লোহাসহ অন্যান্য পদার্থের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়াসহ বড় বড় জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ার কারণেই বজ্রপাতের ঘটনা বাড়ছে। বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে হলে সবাইকে বেশি করে অধিক উচ্চতাসম্পন্ন বৃক্ষরোপণ করতে হবে। ধাতব পদার্থের ব্যবহার কমাতে হবে। জলাশয়গুলো রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, বজ্রপাত প্রতিরোধের লক্ষ্যে নেত্রকোনা প্রশাসনের উদ্যোগে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ৩০৫টি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের দুই পাশে ১ লাখ ৪০ হাজার তাল গাছ রোপণ করা হয়।

নেত্রকোনা জেলা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এম মুখলেছুর রহমান খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, কৃষকরা খাদ্যযোদ্ধা। নেত্রকোনায় প্রতি বছর বহু কৃষক বজ্রপাতে মারা যান। অসহায় হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করেন তাদের স্বজনরা। তাদের পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য সরকারিভাবে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

নেত্রকোনা সদর আসনের সংসদ সদস্য ও সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু ঢাকা পোস্টকে বলেন, নেত্রকোনায় বজ্রপাতে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের এককালীন আর্থিক সহায়তা দেওয়াসহ সরকারি ভাতার আওতাভুক্ত করা হয়। তবে এসব পরিবারের কেউ যদি অভাবে থাকে তাহলে সহায়তার ব্যবস্থা করা হবে। অসহায় পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের জন্য সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা করব।

এএম/জেএস