সুনামগঞ্জ জেলার হাওরের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছে শিশু ফারজিনা। রাষ্ট্রীয় পদক পাওয়ার আনন্দের সেই চমক দেখা যায় তার চোখে। কিন্তু যেই পুরস্কার তাকে এনে দিল সম্মান ও আনন্দ সেই ট্রফি, স্বর্ণপদক ও ক্রেস্ট রাখার মতো জায়গা নেই তাদের ঘরে।

অভাবের তাড়নায় ভিটেমাটি বিক্রি করে তারা থাকে পরের ঘরে আশ্রিত হয়ে। তাই অর্জিত পুরস্কারগুলো নিজের ঘরে রাখার সৌভাগ্য হলো না ফারজিনার। প্রতিবেশী ঘরের ট্রাঙ্কে স্থান হয়েছে শিশুশিল্পী ফারজিনার পুরস্কারের। সেখানে যত্নে রাখা তার ট্রফি, মেডেলসহ অন্যান্য পুরস্কার। এখন নিজ ঘরে থেকে পড়ালেখা করে বড় হয়ে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখছে ফারজিনা ও তার পরিবার। তাদের এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়েছেন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক। 

সুনামগঞ্জ জেলা শহর থেকে জলে-স্থলে সাড়ে ৩ ঘণ্টার দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হয় তাহিরপুর উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের চিলান তাহিরপুর গ্রামে। পানি বেষ্টিত দরিদ্র এ গ্রামেই বেড়ে উঠেছে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০২২ এর শিশু শাখায় বিশেষ পুরস্কার জয়ী ফারজিনা। অনুন্নত যোগাযোগ আর শিক্ষা-দীক্ষার দিক থেকে পিছিয়ে পড়া হাওর পাড়ের আরও অসংখ্য সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মধ্যে একজন ফারজিনা। ফারজিনার বাবা পেশায় একজন জেলে, মা গৃহিণী। অভাবের তাড়নায় বিক্রি করে দিয়েছেন নিজের ঘরবাড়ি। দীর্ঘদিন ধরে থাকছেন পরের ঘরে আশ্রিত হয়ে।

প্রতিবেশীর ঘরের ট্রাঙ্কে জাতীয় পুরস্কার রাখছেন ফারজিনার মা

ফারজিনার নানি সেতারা বেগম বলেন, ঘরবাড়ি বিক্রি করার পর আমার মেয়ে, জামাই, নাতি-নাতনি আমার ঘরে থাকছে। আমি ঠাঁই দিয়েছি তাদের। আমি তো নানি, তাদের ফেলে দিতে পারি না। আমার নাতনির এই পুরস্কারে আমি খুশি।

রাষ্ট্রীয় পদক পাওয়ার আনন্দ থাকলেও ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপচারিতায় অভাব অনটন আর দুঃখ-কষ্টের কথা মনে করে মন ভারী হয়ে যায় ফারজিনার মা আফিয়া বেগমের। তিনি বলেন, তিন বেলার মধ্যে একবেলা খেয়ে দিন কাটিয়েছি। কাপড়- চোপড়ও ঠিকমতো পাইনি। ছেলে-মেয়েদেরও দিতে পারিনি। আমাদের অভাবের সংসার দেখে অন্যরা কাঁদছে। এতো কষ্টের মধ্যে মেয়ের এই পুরস্কার পাওয়া স্বপ্নের মতো আমাদের কাছে। 

ফারজিনার চলচ্চিত্র যুক্ত হওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ ছবির পরিচালক কাইয়ুম স্যার আমাদের গ্রামে আসেন ছবির জন্য জায়গা খোঁজতে। আমাদের গ্রামে এসে তিনি আমার মেয়েকে দেখেন। তখনই আমাকে বলেন, আপনার মেয়েকে আমাদের দরকার। আমি রাজি হলে স্যার তখন বললেন একটা ছবিতে অভিনয় করার জন্য লাগবে কিছু সময়ের জন্য। আমরা রাজি থাকায় পরে তিনি ফারজিনাকে দিয়ে অভিনয় করান। 

তারপর হঠাৎ কয়েকমাস আগে আবার স্যার ফোন দিয়ে বললেন, ফারজিনার আম্মু আপনাদের মেয়ের কাগজপত্র দরকার। কাগজপত্র দিলে কিছু টাকা হয়তো পাব এই আশায় দ্রুত ইউনিয়ন অফিস থেকে তার জন্ম নিবন্ধনের কাগজ ঠিক করে স্যারের কাছে পাঠাই। এরপর স্যার আবার একদিন বললেন যে ঢাকায় আসতে হবে। তখনও জানি না কি পুরস্কার বা কেন যাচ্ছি। গিয়ে জানতে পারি এতো বড় অনুষ্ঠান আর প্রধানমন্ত্রী নিজে পুরষ্কার দেবেন। 

তিনি আরও বলেন, আমার মেয়েকে পড়ালেখা করাতে চাই। পড়ালেখার পাশাপাশি যদি কাইয়ুম স্যারের মতো অন্য কেউ আমার মেয়েকে নিয়ে চলচ্চিত্রে কাজ করাতে চায় তাহলে আমার মেয়েও ভবিষ্যতে চলচ্চিত্রে কাজ করবে। 
 
ফারজিনার বাবা আবু সায়েম বলেন, গ্রামের সাধারণ পরিবারের সন্তান আমি। কখনো মাছ ধরে কখনো মৌসুমি কাজ করে সংসার চালাই। আমার জীবনে প্রধানমন্ত্রীর সামনে যাব এটা চিন্তাও করি নাই। মেয়ে আমাকে এতো বড় সম্মানের জায়গায় নিয়ে গেল। মেয়ের কারণে অনেক বড় বড় মানুষ এখন আমাদের খোঁজ নিচ্ছেন, সহযোগিতা করছেন। মেয়েকে নিজ ঘরে পড়ালেখা করিয়ে মানুষের মতো মানুষ বানানোটাই এখন স্বপ্ন। 

এতো সংগ্রাম আর প্রতিবন্ধকতার শিকল ভেঙে ফারজিনা এ বছর পেয়েছে চলচ্চিত্র অঙ্গনের সর্বোচ্চ সম্মান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ‘কুড়া পক্ষীর শূনে উড়া’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য শিশুশিল্পী শাখায় গত মঙ্গলবার (১৪ নভেম্বর) প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে বিশেষ পুরস্কার গ্রহণ করে সে। তবে পুরস্কার পেলেও সেই অর্জন রাখার জন্য ঘর নেই এই শিশুশিল্পীর। তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে পাওয়া পুরস্কার তাকে রাখতে হয়েছে প্রতিবেশীর ঘরের ট্রাঙ্কে। পুরস্কারের পর একটা ঘর পাওয়ার স্বপ্ন এখন তাদের। সেই ঘরে থেকে পড়ালেখা করে শিক্ষক হতে চায় ফারজিনা। 

এদিকে হাওরের পিছিয়ে পড়া জনপদের ফারজিনার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া নিয়ে হাওর পাড়ে বইছে বাঁধ ভাঙা খুশির জোয়ার। ফারজিনাকে নিয়ে গর্বিত তারা। গৃহহীন ফারজিনাকে একটা ঘর করে দেওয়ার দাবি তাদেরও। তাই ফারজিনার লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়ে জায়গা সহ ঘর নির্মাণেরও আশ্বাস দিয়েছেন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী। 

আরকে