অন্যের ফসলি জমিতে কাজ করে বৃদ্ধ মায়ের ওষুধ খরচসহ সংসার পরিচালনা করেন খাদিজা আক্তার। তার বাইসাইকেল চুরি হওয়ার পর যাতায়াত খরচের অভাবে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। এমন খবর প্রকাশের পর খাদিজা আক্তারকে একটি বাইসাইকেল উপহার দিয়েছেন শরীয়তপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জ্যোতি বিকাশ চন্দ্র। 

রোববার (১৯ নভেম্বর) দুপুরে শরীয়তপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিস চত্বরে খাদিজাকে বাইসাইকেলটি উপহার দেওয়া হয়।

এর আগে গত ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা পোস্টে খাদিজার জীবন সংগ্রাম নিয়ে ‘অন্যের জমিতে কাজ করে সংসার চালান বাবাহারা খাদিজা’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ওই সংবাদ প্রকাশের পর শরীয়তপুর সদর উপজেলা প্রশাসন খাদিজার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দেয়। প্রাথমিকভাবে খাদিজা আক্তার উপজেলা প্রশাসনের কাছে একটি বাইসাইকেল দাবি করেন। পরে উপজেলা প্রশাসন তার পছন্দমতো একটি বাইসাইকেল তাকে উপহার দেন।

শরীয়তপুর সদর উপজেলার উপরগাঁও এলাকার কীর্তিনাশা নদীর পাড়ের বাসিন্দা মৃত সিরাজ শেখ ও সালেহা বেগম দম্পতির ছোট মেয়ে খাদিজা আক্তার। তিনি তার বৃদ্ধ মা সালেহা বেগমকে নিয়ে রঙের বাজার এলাকার আশ্রয়ণ প্রকল্পে তার বোনের ঘরে বসবাস করেন।

আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা, খাদিজা আক্তার ও তার পরিবার সূত্রে জানা যায়, এক যুগ আগে চার মেয়ে ও এক ছেলেকে রেখে মারা যান রিকশা গ্যারেজের শ্রমিক সিরাজ শেখ। আধা শতাংশ জমির ওপর ছোট্ট একটি ঝুপড়ি ঘর ছাড়া ছেলে মেয়েদের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারেননি সিরাজ শেখ। ছয় বছর বয়স থেকে অন্য ভাইবোনদের সঙ্গে শুরু হয় খাদিজার জীবন সংগ্রাম। অন্যের ফসলি জমিতে নিরানিসহ বিভিন্ন কাজ করে সংসার ও পড়াশোনা ভালোই চলছিল খাদিজার। বড় ভাইবোনেরা বিয়ে করলেও মাঝে মধ্যে খাদিজা ও তার মাকে সহযোগিতা করতেন। কিন্তু কয়েক বছর ধরে খাদিজার বড় বোন মঞ্জিলা বেগমের স্বামী রাজমিস্ত্রির সহকারী সালাম বেপারী ভবন থেকে পড়ে গিয়ে অসুস্থ। মেজো বোন সাহিদা বেগম আগুনে পুড়ে অসুস্থ। তার স্বামী রুবেল ব্যাপারী ক্যান্সার আক্রান্ত। সেজো বোন পিংকি আক্তারের পাকস্থলী ছিদ্র হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। 

ভাই মিরাজ শেখ পেশায় একজন অটোরিকশা চালক। তিনি তার দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে আংগারিয়াতে বাসা ভাড়া থাকেন। খাদিজা আক্তারের মা সালেহা বেগম বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। সংসারের খরচ, মায়ের ওষুধ, নিজের পড়াশোনা সব কিছুর ব্যয়ভার খাদিজা আক্তারকে বহন করতে হয়। খাদিজা অন্যের ফসলি জমিতে কৃষি কাজ করে উপার্জন করেন। কঠোর পরিশ্রমের এসব কাজ করেও খাদিজা পড়াশোনা ছেড়ে দেননি কখনো। হাইস্কুলে পড়ার সময় থেকে শরীয়তপুর স্টেডিয়ামে ক্রিকেটের প্র্যাকটিস করেন। খাদিজা আক্তার নারী ক্রিকেট দল শরীয়তপুরের হয়ে ঢাকা, রংপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, ময়মনসিংহ, মাদারীপুরসহ বিভিন্ন জেলায় বিজয় অর্জন করেছেন। পরিবারের অর্থাভাবে এখন আর খাদিজা আক্তার ক্রিকেট প্র্যাকটিস করেন না। শরীয়তপুরের আংগারিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও সরকারি গোলাম হায়দার খান মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে উচ্চ শিক্ষার জন্য ওই কলেজেই খাদিজা আক্তার ভর্তি হয়েছেন। গত ৫ সেপ্টেম্বর অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার জন্য শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে গেলে হাসপাতালের সিঁড়ির নিচ থেকে খাদিজা আক্তারের সাইকেলটি চুরি হয়ে যায়। সাইকেল চুরি হওয়ার পর খাদিজার কলেজে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। 

বাইসাইকেল উপহার পেয়ে খাদিজা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকা পোস্টে সংবাদ প্রকাশের পর ইউএনও স্যার আমার পরিবারের খোঁজখবর নিয়েছেন। তিনি তাৎক্ষণিক আমাকে একটি বাইসাইকেল দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যে সাইকেলটি দিতে চেয়েছিলেন সেটি চালাতে আমার কষ্ট হবে বলে স্যারকে জানিয়ে ছিলাম। এরপর তিনি আমার পছন্দ অনুযায়ী একটি সাইকেল কিনে দিয়েছেন। সাংবাদিকসহ স্যারকে অনেক ধন্যবাদ। আমি এখন থেকে নিয়মিত কলেজে যেতে পারব। যারা আমার পরিবারকে বিভিন্ন সময় সহযোগিতা করেছে, তাদের প্রতি আমার পরিবার কৃতজ্ঞ। ছোট্ট একটি চাকরি পেলে আমি পরিবারকে নিয়ে ভালোভাবে চলতে পারতাম। ফসলি জমিতে কষ্টের কাজ করতে হত না।

শরীয়তপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জ্যোতি বিকাশ চন্দ্র ঢাকা পোস্টকে বলেন, গণমাধ্যমে খাদিজার সংগ্রামের কথা আমি জানতে পারি। পরে তাকে তাৎক্ষণিক একটি বাইসাইকেল দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলাম। তখন সে তার পছন্দমতো সাইকেল দাবি করে। তার পছন্দমতো সাইকেল দিতে গিয়ে একটু দেরি হয়েছে। খাদিজার বৃদ্ধ মায়ের চিকিৎসা ও তার সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য কাজ করবে উপজেলা প্রশাসন।

সাইফুল ইসলাম সাইফ রুদাদ/আরএআর