স্ত্রী রেনু ঋষির থেকে ডিভোর্সের পরও এক সঙ্গে ছিলেন মুকুল চন্দ্র রায়। কিন্তু রেনু ঢাকায় গাজীপুরে কাজের জন্য গেলে তার সম্পর্ক হয় আল আমিন নামের এক যুবকের সঙ্গে। সেই সম্পর্কই কাল হয়ে দাঁড়ালো রেনু ঋষির মা চিন্তা ঋষির (৬৬) জন্য। মেয়ের সাবেক স্বামীর হাতে নির্মমভাবে খুন হতে হলো তাকে। খুনের পর বাড়ির পাশে রাখা পরিত্যক্ত রিং স্ল্যাবের মধ্যে তার মরদেহ মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়। 

গত সোমবার (৬ নভেম্বর) সেখান থেকে দুর্গন্ধ বের হলে মরদেহ উদ্ধারের পর পুলিশের তদন্তে উঠে আসে বৃদ্ধা নারীর খুনের রহস্য। ঘটনাটি ঘটেছে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার পৌরসভার মধ্যপাড়া গ্রামে।

এ ঘটনায় দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আসামিরা হলেন, মুকুল চন্দ্র রায় (৩৬) ও মহাদেব ঋষি (২৫)। তাদের মধ্যে মুকুল চন্দ্র রায় নীলফামারীর জলঢাকা বালাগ্রাম চন্ডীহাটি এলাকার মৃত খগেশ্বরের ছেলে ও মৃত চিন্তা ঋষির সাবেক জামাই এবং মহাদেব ঋষি একই জেলার ডিমলার উত্তর সোনাখুলি এলাকার দেবদাস ঋষির ছেলে ও চিন্তা ঋষির নাতনী জামাই।

মঙ্গলবার (৭ নভেম্বর) দুপুরে বৃদ্ধা নারীর খুনের রহস্য উন্মোচনের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে সংবাদ সম্মেলন করেছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) কনক কুমার দাস। তিনি হত্যাকাণ্ডের ৮ ঘণ্টার মধ্যে ঘটনার রহস্য উন্মোচন, আলামত উদ্ধার ও খুনিকে গ্রেপ্তার করে সাংবাদিকদের সামনে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন।

কনক কুমার দাস সাংবাদিকদের জানান, হত্যার শিকার চিন্তা ঋষি ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। গত ৬/৭ দিন ধরেই তিনি নিখোঁজ ছিলেন। তাকে খুঁজে না পাওয়ায় নাতি জীবন (২২) ও সৎ ছেলে নেপাল ঋষি (৩৮) গত সোমবার দুপুরে বাড়িতে খোঁজাখুঁজি করেন। এক পর্যায়ে বসতবাড়ির টিউবওয়েল ও চুলার মাঝামাঝি পরিত্যক্ত রিং স্ল্যাব থেকে দুর্গন্ধ পেয়ে প্রতিবেশিদের ডেকে আনা হয়। পরে স্থানীয়রা পুলিশে খবর দিলে তারা এসে দুর্গন্ধপূর্ণ জায়গাটি থেকে ওই নারীর অর্ধ গলিত মরদেহ উদ্ধার করে। মরদেহের সুরতহালে দেখা যায়, নিহত চিন্তা ঋষির গলাকাটা, বুকের মাঝখানে ধারালো অস্ত্রের আঘাত ও পেটের ডান পার্শ্বে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।  

এ ঘটনায় প্রাথমিকভাবে অনুসন্ধান ও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ভুক্তোভোগীর পরিবারের ৫ জনকে থানা হেফাজতে নেওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদে চিন্তা ঋষিকে খুন করে লাশ গুমের ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত মুকুল চন্দ্র রায়ের (৩৬) নাম উঠে আসে। মুকুল চন্দ্র রায় চিন্তা ঋষির মেয়ে রেনু ঋষির সাবেক স্বামী। 

হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দিয়ে পুলিশ জানায়, ৬/৭ বছর আগে খুনের মুলহোতা মুকুল চন্দ্র রায়ের সঙ্গে রেনু ঋষির বিয়ে হয়। বিয়ের কিছুদিন স্বাভাবিকভাবে ঘর সংসার করার পর রেনু জানতে পারেন স্বামী মুকুল চন্দ্র রায়ের পূর্বের আরেক স্ত্রী আছে। বিষয়টি জানতে পেরে রেনু স্বামী মুকুল চন্দ্র রায়কে তালাক দিয়ে মায়ের সঙ্গে বসবাস শুরু করেন। তালাক দিলেও কিছুদিন পর থেকে আবারও মুকুল চন্দ্র রায় ও রেনু ঋষি স্বামী-স্ত্রীর ন্যায় থাকতে শুরু করেন। এর একপর্যায়ে রেনু ঋষি কাজের জন্য গাজীপুর গেলে সেখানে আল আমিন নামের এক যুবকের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রেমের সম্পর্কের সূত্র ধরে প্রেমিক আল আমিনকে বাড়িতে নিয়ে আসে রেনু। তা দেখে মুকুল চন্দ্র বুঝতে পারেন তার সাবেক স্ত্রী আরেকজনের প্রেমে পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ করলে নিহত চিন্তা ঋষি মেয়ের সম্পর্ককে সমর্থন করে সাবেক জামাতা মুকুলের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন। সাবেক স্ত্রী রেনুর এমন কার্যকলাপ মেনে নিতে না পেরে তাদের অনুসরণ করে মুকুল গাজীপুর যান। সেখানে গিয়ে রেনু ও তার প্রেমিক আল আমিনের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। এরপর মুকুল রেনুর প্রেমিক আল আমিন ও তার মাকে খুন করার হুমকি দিয়ে নিজ বাড়িতে চলে যান।

এ ঘটনার পর গত ৩১ অক্টোবর সকাল ৯টায় পরিকল্পনা করে মুকুল চন্দ্র রায় সাবেক শাশুড়ি চিন্তা ঋষির বাড়িতে যান। সেদিনই দুপুরে শাশুড়ির হাতে ২০০ টাকা দিয়ে বাজার থেকে মুরগি কিনেও আনান। সে মুরগির মাংস দিয়ে দুপুর ও রাতে খাওয়া-দাওয়া করে। রাতে চিন্তা ঋষি পূজার ঘরে ঘুমিয়ে পড়লে রাত সাড়ে ১২টা থেকে ১টার মধ্যে মুকুল ঘরে ঢুকে ধারালো ছুরি দিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় চিন্তা ঋষির গলার শ্বাসনালি কেটে হত্যা করেন। এসময় সে বৃদ্ধার বুকে-পেটে একাধিক কোপ মারেন। পরে ঘর থেকে মরদেহ তুলে এনে বাড়ির পরিত্যক্ত রিং স্ল্যাবের মধ্যে মাটি চাপা দিয়ে দেন।

নিহতের নাতনী জামাই মহাদেব ঋষির সহযোগিতায় মুকুল এই কাজ করেছে বলে স্বীকার করেন। পুলিশ ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে হত্যার কাজে ব্যবহৃত ধারালো ছোরা, প্লাস্টিকের বালতি ও জগ জব্দ করে। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেবীগঞ্জ থানা পুলিশের আসামির বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হয় ও বিকেলে তাদেরকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হয়।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কনক কুমার দাস বলেন, ঘটনাটি প্রায় ক্লুলেস অবস্থায় ছিল। তারপরেও আমরা তৎপর হয়ে মাঠে নেমে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে আসামি দুইজনকে গ্রেপ্তার করি। জিজ্ঞাসাবাদে তারা হত্যার বিষয়টি শিকার করেছে। মঙ্গলবার আদালতের মাধ্যমে তাদেরকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে।

এসকে দোয়েল/আরকে