মেঘনা নদীর তীর ঘেষা বরিশাল জেলার মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা। এই উপজেলার সবগুলো ইউনিয়নই জেলে প্রধান। তারমধ্যে অন্যতম দড়িচর খাজুরিয়া ইউনিয়ন। 

এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোস্তফা রাঢ়ী জানিয়েছেন, ইউনিয়নে ১৪শ নিবন্ধিত জেলে থাকলেও বরাদ্দ পেয়েছেন ১১৫০ জন। মোট জেলের মধ্যে ২৫০ জনের বরাদ্দই আসেনি। তিনি বলেন, সহায়তার চাল দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে। সংসারে লোক পাঁচজন। আয় যদি হয় তিনজনের। তাহলে বাকি দুইজন কি না খেয়ে থাকবে? প্রশ্ন তুলে এই জনপ্রতিনিধি বলেন, সঠিকভাবে সহায়তা না পেয়ে অনেক জেলেই বাধ্য হয়ে চুরি করে মাছ ধরতে যায়।

শুধু দড়িচর খাজুরিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নয় বরিশাল সদর উপজেলা, বাবুগঞ্জ, হিজলা, বানারীপাড়া, মুলাদী উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের সঙ্গে আলাপ করে একই চিত্র জানা গেল।

মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান শেষ হওয়ার পরও নিবন্ধিত অনেক জেলে এভাবে সরকারি সহায়তা পায়নি। খোদ মৎস্য অধিদপ্তর জানায় নিবন্ধিতের অনুকূলে সহায়তার বরাদ্দ না আসার তথ্য। এতে করে বিভাগের ৬ জেলার মধ্যে দুটি জেলায় অভিযান ফলপ্রসু হয়নি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইলিশ সংরক্ষণ করতে হলে সবার আগে জেলেদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নাম মাত্র খাদ্য সহায়তা দিয়ে অভিযান সফল করা সম্ভব নয়।

মৎস্য অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন জানান, বিভাগে মোট নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৪ লাখ ২৫ হাজার ৯ জন। এর মধ্যে শুধুমাত্র ইলিশ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন এমন জেলে রয়েছেন ৩ লাখ ৮২ হাজার ৭১ জন। মা ইলিশ সংরক্ষণে ১২ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিনের অভিযানে খাদ্য সহায়তার ২৫ কেজির চাল বরাদ্দ এসেছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৪১ জনের জন্য।

সরকারি এই কর্মকর্তার দেওয়া হিসেব বলছে, নিষেধাজ্ঞা শেষ হলেও এখনো ১ লাখ ১৭ হাজার ১৬৮ জন জেলে সরকারি সহায়তা পায়নি।

একই দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, নিষেধাজ্ঞাকালীন ৮০৮ জেলেকে কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। ৬ জেলার মধ্যে কারাদণ্ডের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বরিশাল জেলায় ৪৮৬ জন। এরপরই ভোলা জেলায় ২২৬ জন।

এছাড়া বরগুনা জেলায় রয়েছে একজন, পিরোজপুর জেলায় ৫ জন, পটুয়াখালী জেলায় ৭১ জন এবং ঝালকাঠি জেলায় ১৯ জন।

ভোলা জেলার ভেলুমিয়া ইউনিয়নের নিবন্ধিত জেলে ইউসুফ বেপারী বলেন, ইলিশ রক্ষা অভিযান এমন হয়েছে সরকার চোরকে বলে চুরি করতে আবার গৃহস্থকে বলে সজাগ থাকতে। জেলেদের যদি সঠিকভাবে ২২ দিনের সংসার চালানোর খরচ সরকার দিতো তাহলে একজন জেলেও নদীতে নামতো না। কিন্তু তা সরকার করে না। অভিযানও দেয় আবার জেলেদের ঘরেও থাকতে বলে। জেলেদের ঘরে যে ছেলেমেয়ে রয়েছে তারা খাবে কি প্রশ্ন রাখেন এই জেলে। তিনি জানান, বিগত তিন বছরের মধ্যে এবারসহ দুইবার সহায়তার চাল পাইনি। অথচ আমি নিবন্ধিত জেলে।

বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার রহমতপুর ইউনিয়নের মীরগঞ্জ এলাকার জেলে রুবেল বলেন, সারাবছর মাছ ধরে সংসার চালাই আমরা। এক বেলা নদীতে না নামলে ঘরের চুলা জ্বলে না। অবরোধ আসলে জেলেদের তালিকায় আমার নাম থাকে না। এজন্য এবারও সুযোগ পেলেই নদীতে নেমে মাছ ধরেছি। 

সচেতন নাগরিক কমিটি বরিশাল জেলার সভাপতি অধ্যাপক গাজী জাহিদ হোসেন বলেন, ইলিশ রক্ষা অভিযান সফল হলো কিনা সেটি আপেক্ষিক বিষয়। খেটে খাওয়া মানুষকে আইন দেখিয়ে, জেলে ঢুকিয়েই বলা যাবে না অভিযান সফল হয়েছে। অথচ বছরের পর বছর আমরা এই চর্চা দেখছি। এটিকে আমি বলব কিছু কর্মকর্তার স্ট্যান্টবাজি।

গাজী জাহিদ হোসেন বলেন, জেলে শ্রেণি অত্যন্ত নিম্নবৃত্ত জীবনযাপন করে। অবরোধ সফল করতে হলে আগে তাদের মৌলিক অধিকার রাষ্ট্রকেই পূরণ করতে হবে। কাউকে অভুক্ত রেখে নদীতে নামতে দেবেন না এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার সরকারের নেই। আমি দাবি জানাব, নিবন্ধিত বা অনিবন্ধিত যে সংখ্যক জেলে হোক ইলিশ সংরক্ষণ অভিযানকালীন তাদের পর্যাপ্ত সহায়তা নিশ্চিত করার পরই নদীতে তাদের নামতে বারণ করা যেতে পারে।

মৎস্য অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগের উপ-পরিচালক নৃপেন্দ্র নাথ বিশ্বাস বলেন, বিভাগের দুটি জেলা ছাড়া বাকি জেলাগুলোতে সফলভাবেই আমরা অভিযান শেষ করেছি। শুধু ভোলা ও বরিশাল জেলায় কিছু জেলেদের নদীতে নামা থেকে বিরত রাখা যায়নি। অভিযানে এবার আমাদের অভিজ্ঞতা হলো। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আগামী নিষেধাজ্ঞায় আরও সফল অভিযান পরিচালনা করা হবে।

সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরকে