অবরোধ-শ্রমিক আন্দোলনে গাজীপুরে আতঙ্ক
বিএনপি-জামাতের ডাকে সারা দেশে তিন দিনের অবরোধ চলছে। এরই মাঝে গাজীপুরের বিভিন্ন শিল্প কারখানার শ্রমিকরা বেতন বাড়ানোর দাবিতে অষ্টম দিনের মতো আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপি-জামায়াতের অবরোধ ও শ্রমিক আন্দোলনে মঙ্গলবার (৩১ অক্টোবর) দিনভর মৌচাক-শফিপুর-চন্দ্রা এলাকাজুড়ে ছিল আতঙ্ক।
মঙ্গলবার (৩১ অক্টোবর) সকালে অবরোধের সমর্থনে জেলার বিভিন্ন স্থানে পিকেটিং করেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। একই সময় গাজীপুর মহানগরের ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের তেলিপাড়া, ভোগড়া বাইপাস, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের মৌচাক এলাকার আশাপাশের বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা বেতন বাড়ানোর দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা-ময়নসিংহ মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেন অবরোধ সমর্থনকারীরা। এ সময় মাওনা চৌরাস্তার পল্লী বিদ্যুৎ মোড়, বেড়াইদেরচালা এলাকার ১নং সিএনবি বাজার, গাজীপুর মহানগরের সালনা এলাকার ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে টায়ারে জ্বালিয়ে আগুন দিয়ে বিক্ষোভ করেন তারা। এছাড়াও সকাল ৭টায় গাজীপুর মহানগরের হাড়িনাল এলাকায় বেকারীর রুটি বহনকারী একটি পিকআপে আগুন দেওয়া হয়। এ সময় তারা সরকার বিরোধী নানা ধরনের স্লোগান দেন।
এর কিছু সময় পর সকাল ৮টা থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ছয়দানা, মালেকের বাড়ি, তেলিপাড়া, বোর্ড বাজার, ভোগড়া বাইপাস, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের মৌচাক, শফিপুর এলাকার শ্রমিকরা বেতন বাড়ানোর দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন। বেলা বাড়ার সাথে সাথে তেলিপাড়া, বোর্ড বাজার ও ভোগড়া বাইপাসের শ্রমিকরা মৌচাক, শফিপুর ও চন্দ্রায় এলাকায় তাণ্ডব চালান। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সফিপুরের বুটমিল এলাকার লিডা ডাইং লিমিটেড নামে কারখানার ঝুটের গুদামে আগুন দেন শ্রমিকরা। আগুনে পাশেই পার্কিং জোনে রাখা দুটি প্রাইভেটকার, একটি মাইক্রোবাস ও বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল পুরো ভস্মীভূত হয়ে যায়।
কিছু সময় পরই সফিপুর এলাকার জেলা ট্রাফিক পুলিশ বক্সে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেন উত্তেজিত শ্রমিকরা। এরপরই চন্দ্রা এলাকার অপর একটি ট্রাফিক পুলিশ বক্সে ভাঙচুর করেন তারা। এছাড়া শফিপুর এলাকার তানহা হেলথ কেয়ার হসপিটাল নামে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ভাঙচুর চালানো হয়। এতে ওই হাসপাতালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে উত্তেজিত শ্রমিকরা গাজীপুরের কালিয়াকৈরের চন্দ্রায় ওয়ালটন কারখানার সামনে ওয়ালটন প্লাজায় হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন। এতে ওয়ালটন প্লাজা পুড়ে যায়। এ সময় ওয়ালটন প্লাজার সামনে থাকা একটি পিকআপ মহাসড়কে এনে আগুন ধরিয়ে দেন শ্রমিকরা। খবর পেয়ে কালিয়াকৈর ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ততক্ষণে শোরুমে থাকা মালামাল পুড়ে যায়।
অন্যদিকে দুপুর দেড়টার দিকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের চন্দ্রা পল্লী বিদ্যুৎ এলাকায় একটি মালবাহী ট্রাক ও পিকআপে আগুন দেন আন্দোলনকারী শ্রমিকরা। এতে ট্রাকের সামনের অংশ পুড়ে গিয়ে মালামালে আগুন লাগে। তার কিছু সময় পরই পাশের একটি পিকআপে আগুন দেন তারা। এ সময় পুলিশ ধাওয়া দিলে শ্রমিকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে মহাসড়ক থেকে সরে যান। এরপর পুলিশ ও শ্রমিকদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে।
এদিকে অবরোধ ও শ্রমিক আন্দোলনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে স্থানীয়দের মধ্যে। অনেকেই গ্রেপ্তার আতঙ্ক, পুলিশি হয়রানি, টিয়ারশেল ও রাবার বুলেটের ভয়ে জরুরি কাজ ছাড়া বাইরে বের হননি।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা প্রহরী মমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, রাতে ডিউটি করতে ভয় লাগে। কখন যে কী হয় সেই আতঙ্কে থাকি। রাতে আগে ঘুমাতাম, হরতাল, অবরোধ ও শ্রমিক অসন্তোষ হওয়ার পর আতঙ্কে ঘুম আসে না।
গাজীপুর মহানগরের তেলিপাড়া এলাকায় কাঁচা বাজার করতে এসেছেন রাবেয়া আক্তার। তিনি বলেন, গাজীপুরের পরিস্থিতি এমন হয়েছে, কখন যে কী হয় বলা যাচ্ছে না। অবরোধ ও শ্রমিক আন্দোলনে বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হচ্ছি না, সন্তানকে স্কুলেও পাঠাচ্ছি না। সকালে ঘরে কিছু কাঁচা তরকারি শেষ হয়ে যাওয়ায় আতঙ্ক নিয়েই বের হয়েছি।
স্থানীয় একটি কারখানায় কাজ করেন নাহিদুল ইসলাম। শ্রমিকদের সহিংস আন্দোলনের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, আমরা যে বেতন পাই তা দিয়ে বর্তমানে চলতে খুবই কষ্ট হয়। কিন্তু আমি এ ধরনের সহিংতাকে সমর্থন করি না। সরকার ও কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন বেতন নির্ধারণে আমাদের সময় দেওয়া দরকার।
গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক মো. আবদুল্লাহ্ আল আরেফিন বলেন, বেতন বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকরা সফিপুরের বুটমিল এলাকার লিডা ডাইং লিমিটেড কারখানার ঝুটের গুদামে আগুন দেন। এতে পার্কিং জোনে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটি গাড়ি পুড়ে গেছে। এছাড়াও জেলা ট্রাফিক পুলিশের বক্স, ওয়ালটন প্লাজাসহ দুটি পিকআপ ও একটি মালবাহী ট্রাকে আগুন দেন। এসব ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা কাজ করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন।
গাজীপুর শিল্পাঞ্চল পুলিশ-২ এর পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম বলেন, পোশাক শ্রমিকদের শান্ত থাকার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তারা সহিংস হয়ে উঠেছেন। উত্তেজিত হয়ে বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিসংযোগ করছেন এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াচ্ছেন। পুলিশ সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ও জানমালের ক্ষতি ঠেকাতে এবং সরকারি সম্পদ রক্ষার জন্য টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
অধিকাংশ কারখানা বন্ধ ঘোষণা
টানা সাত দিন ধরে চলা শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে মঙ্গলবার থেকে অধিকাংশ কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। কারখানা বন্ধ থাকলেও সকাল থেকেই শ্রমিকরা ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এতে মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
বেশ কয়েকটি কারখানার কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা জানান, শ্রমিক বিক্ষোভের কথা বিবেচনা করে সাময়িক সময়ের জন্য কারখানা বন্ধের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কারখানা খুলে দেওয়া হবে।
শিহাব খান/আরএআর