অভয়াশ্রমেও চলছে ইলিশ শিকার
মৎস্য সম্পদ বাড়াতে ইলিশ ধরার ওপর সরকার নির্ধারিত ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলছে। এ নিষেধাজ্ঞা না মেনে মেঘনা নদীতে ইলিশের অভয়াশ্রমে মাছ শিকার করছেন কিছু জেলে।
শরীয়তপুর জেলার গোসাইরহাট উপজেলা, বরিশাল জেলার হিজলা ও মুলাদী উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় মেঘনা ও তার শাখানদী এবং কীর্তনখোলা নদী মিলিয়ে ৩১৮ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ২০১৯ সালে দেশের ষষ্ঠ অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়। এই অভয়াশ্রমে প্রজননের জন্য মা ইলিশ অবস্থান করে।
বিজ্ঞাপন
কিছু অসাধু জেলে এই এলাকায় মাছ শিকার করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রতিদিন ভোরে এবং রাতে ইঞ্জিন চালিত ছোট ছোট ট্রলারে মাছ শিকারে নামেন তারা। এদের অধিকাংশ পেশাদার হলেও কেউ কেউ মৌসুমি জেলে। শুধু শিকার করেই তারা থামছেন না, আশপাশের বাজারে জটলা করে মাছ বিক্রিও করছেন তারা।
এ ব্যাপারে অবগত থাকলেও জেলেদের মারমুখী অবস্থানের কারণে প্রশাসন নিশ্চুপ আছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বরিশালের হিজলা উপজেলার হরিনাথপুর ইউনিয়নের আবুপুর লঞ্চঘাট সংলগ্ন নদীতে বেশ কয়েকটি ইঞ্জিনচালিত ছোট ট্রলারে ইলিশ শিকার চলছে। ওই এলাকার জেলেরা জানিয়েছেন, শুধু আবুপুর নয় হিজলা, মুলাদি, মেহেন্দীগঞ্জ, চাঁদপুরের হাইমচর থেকে শুরু করে ভোলার তেঁতুলিয়া নদী পর্যন্ত শাখানদীগুলোতে সংঘবদ্ধভাবে মাছ শিকার করেন জেলেরা। এসব মাছ নিকটস্থ চাঁদপুর, শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলার বিভিন্ন বাজারে বিক্রি হয়। এমনকি মেঘনার তীরের আবুপুর, হিজলা-গৌরবদি ইউনিয়নের খালিসপুর, জানপুর এলাকায় রাখঢাক ছাড়াই মা ইলিশ বিক্রি করতে দেখা গেছে।
আবুপুর এলাকার জেলে আবু হোসেন বলেন, সরকার থেকে যে প্রণোদনা দেয় তা আমরা পাই না। সংসার তো চালাতে হবে। এজন্য বাধ্য হয়ে নদীতে মাছ শিকারে নামতে হচ্ছে।
হাশেম মিয়া নামে আরেক জেলে বলেন, সরকারের সহায়তা আমাদের হাত পর্যন্ত এসে পৌঁছায় না। যার ফলে পরিবার নিয়ে চলতে কষ্ট হয়। তাই বাধ্য হয়ে মাছ ধরতে নেমেছি। এই এলাকায় প্রশাসন কম আসে বলে এখানে এসেছি।
রুবেল মৃধা নামে আরেক মাঝি বলেন, প্রশাসন শুধু আমাদের সঙ্গেই পারে। আমাদের এখানে নিষেধাজ্ঞার সময়ে ভারতের জেলেরা ঠিকই মাছ ধরে নিয়ে যায়। তাছাড়া আমরা মাছ শিকারে না নামলে এলাকার নেতারা লোক দিয়ে জাল ফেলে। মাছ তো শিকার বন্ধ হচ্ছে না। অন্যরা মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে, আমি ধরলে দোষের কী!
হরিনাথপুর ইউনিয়নের এক জনপ্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এই অঞ্চলটির জেলেরা অনেক মারমুখী। বিগত দু-তিন বছরে ৪/৫টি হামলা করেছে প্রশাসনের ওপর। তাদের হামলার শিকার হয়েছে কোস্টগার্ড, পুলিশ, মৎস্য কর্মকর্তা এমনকি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটও। এই অঞ্চলে ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন আছেন যারা জেলেদের দিয়ে ইলিশ শিকার করান। কোনো ঝামেলা হলে তারা তা ম্যানেজ করেন। ফলে স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি এড়িয়ে যান।
ওই জনপ্রতিনিধি স্বীকার করেন, অভয়াশ্রমে তারও দুটি ট্রলার মাছ শিকারে যায়। অভয়াশ্রমে মাছ শিকার ক্ষতি বুঝলেও তার দাবি, আমি না ধরলেও অন্যরা ধরে নিয়ে যাবে। প্রশাসন ভয়ে এদিকে আসে না। এলাকাটি বরিশাল ও শরীয়তপুর জেলার সীমানা হওয়ায় এখানে প্রশাসনের নজরদারি তেমন থাকে না। মাঝে মধ্যে প্রশাসন কাউকে আটক করলেও সীমানা জটিলতায় ছেড়ে দেয়।
মেঘনায় ইলিশ শিকারের সত্যতা স্বীকার করেছেন বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, আবুপুরের ওই এলাকাটিতে একটু ঝামেলা রয়েছে। এর আগে কয়েকবার অভিযান বাধার মুখে পড়েছে। ফলে সেখানে একটি নৌ-পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়েছে। তারপরও এমন চিত্র (ইলিশ শিকার) থাকার কথা নয়। এই কর্মকর্তা আবুপুর পুলিশ ফাঁড়ির সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
শরীয়তপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, দুটি জেলার তিনটি উপজেলার সংযোগস্থল মেঘনা নদীর ওই এলাকায় জেলেদের মাছ শিকারের অভিযোগ আমরা জানতে পেরেছি। সমস্যা হচ্ছে জেলেরা অত্যন্ত চতুর। যখন শরীয়তপুর জেলার কোনো অভিযানিক টিম ওই এলাকায় যায় তখন তারা বরিশালের সীমানায় ঢুকে অবস্থান নেন। আবার যখন বরিশালের অভিযানিক দল আসে তখন তারা শরীয়তপুরের সীমানায় ঢুকে অবস্থান নেন। ফলে জেলেদের সঙ্গে পেরে ওঠা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
মৎস্য অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক নৃপেন্দ্র নাথ বিশ্বাস বলেন, মেঘনার ওই অঞ্চলে জেলেরা নির্দেশনা উপেক্ষা করেই মা ইলিশ নিধন করছেন এমন সংবাদ আমি জানতে পেরেছি। তবে আমরা চেষ্টা করছি কোস্টগার্ড, মৎস্য অধিদপ্তর, নৌ-পুলিশ সমন্বিতভাবে অভিযান পরিচালনার। শিগগিরই এই অভিযান পরিচালনা করে ইলিশ নিধনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
নৌ-পুলিশ বরিশাল জোনের পুলিশ সুপার কফিল উদ্দিনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, গত ২৪ ঘণ্টায় বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় অভিযান শুরুর পর থেকে মোট ৭৭ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি বরিশাল জেলায় ৬৩ জন, ভোলায় ৫ জন, বরগুনায় ১ জন, পটুয়াখালীতে ৮ জনকে জেল-জরিমানা করা হয়েছে। ৪৩৭টি অভিযানে ৮৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ষষ্ঠ অভয়াশ্রমের আওতায় রয়েছে মেঘনা নদীর দক্ষিণ-পশ্চিমে বরিশাল সদর উপজেলার জুনাহারের মোড়ে আড়িয়াল খাঁ, কীর্তনখোলা, কালাবদর নদীর মিলনস্থল। এর দক্ষিণ-পূর্বে মেহেন্দিগঞ্জের জাঙ্গালিয়ার কালাবদর ও তেঁতুলিয়া নদীর মিলনস্থল। উত্তর-পশ্চিমে হিজলার হরিণাথপুর সংলগ্ন আড়িয়াল খাঁ ও মেঘনা নদীর মিলনস্থল। উত্তর-পূর্বে হিজলা গৌরনদীর মেঘনা নদী।
সৈয়দ মেহেদী হাসান/এএএ