ভুক্তভোগী যুবকদের পরিবার

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের ৬ যুবক মানব পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে মালয়শিয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। 

তাদের মানবেতর জীবনযাপনের ভিডিও চিত্র দেখে ও আকুতির কথা শুনে কান্নায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তাদের মা-বাবা। এছাড়া তারা পাওনাদারদের চাপে জর্জরিত হয়ে পড়েছেন।

তাদের অভিযোগ, মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য উজানচর ইউনিয়ন পরিষদের দফাদার আয়ুব আলী মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তিন মাস আগে ওই যুবকদের মালয়েশিয়ায় পাঠায়।

এ বিষয়ে দফাদার আয়ুব আলীর বিরুদ্ধে মানব পাচার আইনে রাজবাড়ীর আদালতে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এছাড়া ওই যুবকদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে ও ইউপি দফাদারের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার, গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, থানার ওসিসহ বিভিন্ন দপ্তরের কাছে পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে।

ভুক্তভোগী যুবকরা হলেন, গোয়ালন্দ উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের হাজী গফুর মন্ডল পাড়ার শফি শেখের ছেলে শিপন শেখ, আকমল শেখের ছেলে আশিক শেখ, শামসু শেখের ছেলে রোমান শেখ, কানচু মৃধার ছেলে সিরাজ মৃধা, ও মোশারফ শেখ, এবং ফজের শেখের ছেলে জহিরুল শেখ। তারা সবাই একই এলাকার বাসিন্দা।

আটকে পড়া ব্যক্তিদের পরিবারের দাবি, স্থানীয় ইউপি দফাদার দালাল চক্রের সদস্য আয়ুব আলীর মাধ্যমে ৬ যুবককে মালয়েশিয়া নিয়ে যায় মানব পাচারকারী চক্র। মালয়েশিয়া নেওয়ার সময় তাদের ৩ জনের পরিবারের প্রত্যেকের কাছ থেকে ৪ লাখ ৬৫ হাজার টাকা এবং অপর ৩ জনের প্রত্যেকের পরিবারের কাছ থেকে ৪ লাখ ৫০ হাজার করে টাকা হাতিয়ে নেন আয়ুব আলী। পরে তাদেরকে মালয়েশিয়া একটি সন্ত্রসী দলের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়।

মালয়েশিয়ার ওই সন্ত্রাসী চক্রটি সেখানে একটি কক্ষে বন্দি করে এবং তাদের পাসপোর্ট আটকে রেখে নির্যাতন চালায়। এভাবে তারা যুবকদের পরিবারের কাছ থেকে আরও ১ লাখ করে টাকা আদায় করে। 

এ বিষয়ে মালয়েশিয়া থেকে জহিরুল ও শিপনসহ ওই যুবকরা মোবাইলে তাদের উপর অমানুষিক নির্যাতনের বর্ননা দিয়ে জানায়, বাংলাদেশ থেকে আনা তাদের মতো আরো ৩৫ জনকে একই সঙ্গে ছোট একটি ঘরে বন্দি করে তাদের পাসপোর্টও হাতিয়ে নেওয়া হয়। ৩৫ জনকে এক সপ্তাহের খাবার হিসেবে ৩০ কেজি চাল, ৪ কেজি আলু, ২ কেজি পেঁয়াজ, এক প্যাকেট লবণ দেওয়া হয়। কোনো কিছু বলতে চাইলে মারধর করে। সেই সঙ্গে বলে বাড়ি থেকে টাকা পাঠাইতে বল, তাহলে তোদের কাজ ও ভালো খাবার দেব। না হলে নৌকায় করে তোদের সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হবে।

সিরাজ মৃধার স্ত্রী মর্জিনা বেগম বলেন, আমার স্বামী খেত খামারে কাজ করে তিনটি ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসারটা ভালো চলছিল। ওই আয়ুব দফাদার সরকারি পোশাক পরে প্রতিদিন আমার বাড়িতে এসে তাকে ফুসলাইয়া বিদেশে ভালো চাকরি দেওয়ার লোভ দেখাইয়া সহায় সম্বল বিক্রি করাইয়া ও ধার দেনা করে ৪ লাখ ৬৫ হাজার টাকা নিয়া বিদেশ পাঠাইছে। এখন তাকে কোন কাজ না দিয়ে আটকে রেখে আরও টাকা চাচ্ছে। আমি এখন কোথায় টাকা পাব? আমার ঘরে খাবার নেই। ছেলে-মেয়েরা না খেয়ে স্কুলে যেতে পারছে না। 

মোশাররফের বোন মুক্তা বেগম বলেন, শিশুকালে মা-বাপ মারা যাওয়ার পর এতিম হইয়া ছোট ভাইটাকে নিয়ে অনেক কষ্ট করে বড় হইছি। ওই আয়ুবের প্রলোভনে পড়ে স্বামীকে অনুরোধ করে ধার করা ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকায় ভাইটারে বিদেশ পাঠাইছি। এখন আমার ভাইটা যখন মোবাইলে বলে বুবু আমারে বাঁচাও, না খেয়ে আছি। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। তখন কেমনে কি করি বুঝতে পারি না!! কলিজাডা ফাইটা যায়। ছোটকাল থেকে মায়ের স্নেহ দিয়ে ওরে বড় করছি বলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।

রোমান শেখের পিতা শামসু শেখ ও শিপনের পিতা শফিক শেখ বলেন, ওই আয়ুব দফাদারের প্রলোভনে ছেলেরা মালয়েশিয়া গিয়ে আটকে আছে। আমাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ৪ লাখ ৬৫ হাজার করে টাকা নিয়ে আমাদের ফকির করেছে। ওর বিরুদ্ধে রাজবাড়ী আদালতে মানব পাচার আইনে মামলা দিয়েছি। আমরা এর বিচার চাই। এছাড়া ছেলেদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে মানব পাচারকারী আয়ুবের শাস্তি নিশ্চিত করতে ইউএনও, থানা পুলিশসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।

আলাপকালে উজানচর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য লিয়াকত হোসাইন লিপু বলেন, আমাদের ওই দফাদার মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য এটা আমাদের জানা ছিল না। শুনেছি আয়ুব সামান্য বেতনে দফাদারি চাকরির আড়ালে অবৈধ মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত হয়ে দুইটি ট্রাক, অনেক জায়গা জমি ও বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছেন। এলাকার যুবক ছেলেদের ফুসলাইয়া বিদেশে পাচার করে তাদের পরিবারকে নিঃস্ব করে অবৈধ টাকা কামিয়ে নিজে রাতারাতি বড়লোক হচ্ছে। এটা অনেক বড় অন্যায়। এর বিচার হওয়া দরকার। 

অভিযোগের বিষয়ে দফাদার আয়ুব বলেন, আমি ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে লোক পাঠাই। মানব পাচার করি না। আমি যাদের পাঠিয়েছি তারা সবাই বই পেয়েছে এবং কাজও পেয়েছে। তারা এখন ভালো আছে। 

এ বিষয়ে গোয়ালন্দ ঘাট থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) স্বপন কুমার মজুমদার বলেন, আয়ুব দফাদারের বিষয়ে কোর্টে মামলা হয়েছে। থানাতেও লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। তদন্ত কাজ চলছে। তদন্ত শেষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মীর সামসুজ্জামান/আরকে