বাজারে মিয়াকো কোম্পানির একটি ভ্যাকুয়াম ক্লিনার মেশিন অর্থাৎ মেঝের ধুলোবালি শোষণ ও পরিষ্কার করার যন্ত্র বিক্রি হয় আট হাজার পাঁচশ টাকায়। সেই একই মডেলের ভ্যাকুয়াম ক্লিনার সরকারি একটি কলেজের জন্য কেনা হয়েছে ২৭ হাজার ৮৫০ টাকায়। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া নতুন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের জন্য মিয়াকো কোম্পানির এমন ৪টি ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ক্রয় করে দাম দেখানো হয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার চারশত টাকা।

এছাড়াও চোখ কপালে উঠার মত দাম দেখানো হয়েছে অন্যান্য মালামালেও। সাতশ টাকার ফুটবলের দাম দেখানো হয়েছে ২৪০০ টাকা। ২০ টাকার বৈদ্যুতিক লাইটের দাম দেখানো হয়েছে ৪০০ টাকা। স্থানীয় বাজার থেকে শিঙাড়া কিনে ভাউচারে বিরিয়ানি দেখানো হয়েছে। এমন বেশ কয়েকটি খাতে মালামাল ক্রয় করে বেশি দামের ভুতুড়ে ও ভুয়া বিল ভাউচার করে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. নুরুল হকের বিরুদ্ধে। 

বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরের আর্থিক ব্যয়ের সকল বিল ভাউচারের কপি এসেছে ঢাকা পোস্টের হাতে। অনুসন্ধান করে দেখা যায়, প্রতিটি মালামালে বাজারের চাইতে অনেক বেশি দাম দেখানো হয়েছে। এমনকি শিঙাড়া ও কলা খাইয়ে বিরিয়ানির বিল ভাউচার করা হয়েছে। আর এসব বিলের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন অধ্যক্ষ নিজেই। এছাড়াও কাজ না করিয়ে তিন ধাপে শ্রমিক মজুরির বিল ভাউচার করে প্রায় ৪০ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে।

ভ্যাকুয়াম ক্লিনারটির বাজার দর ৮৫০০ টাকা হলেও কেনা হয়েছে প্রায় ২৮ হাজার টাকায়।

কলেজ সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালে কারিগরি মানবসম্পদ গড়ার লক্ষ্যে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শুরু করে কলেজটি। কলেজটির ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরের বাজেট ছিল ৬৩ লাখ টাকা। চলতি মাসের জানুয়ারিতে নতুন ভবনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। নতুন ভবনের জন্য ক্রীড়া সামগ্রী, শিক্ষা ও শিক্ষণ উপকরণ, কাঁচামাল, খুচরা যন্ত্রাংশ ও রাসায়নিক দ্রব্যাদি কেনা হয়।

আর এসব মালামাল কেনার জন্য ওই কলেজের অধ্যক্ষ নিজেকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি ক্রয় কমিটি গঠন করে। পরে দরপত্র আহ্বান না করেই নিজের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৭ লাখ ৪৭ হাজার ৭৭৫ টাকার মালামাল ক্রয় করেন কলেজের অধ্যক্ষ প্রকৌশলী মো. নুরুল হক। যেখানে বাজার মূল্যের চাইতে প্রতিটি মালামালে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ দাম বেশি দেখানো হয়েছে। তিন গুণ বেশি দাম দেখানো হয়েছে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার মেশিনের।

এছাড়াও একই অর্থবছরে টেন্ডার ছাড়া ১ লাখ ৪৬ হাজার ব্যয় দেখানো হয়েছে বিভিন্ন খাতে। যার মধ্যে রয়েছে কম্পিউটার সামগ্রী ক্রয়, কম্পিউটার মেরামত, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সামগ্রী ক্রয়, আসবাবপত্র মেরামত, আপ্যায়ন বিল ও অনিয়মিত শ্রমিক মজুরি বিল। এরমধ্যে গাজীপুরের একটি হোটেলের ক্যাশ মেমো দিয়ে ৩টি আপ্যায়ন বিল করা হয়েছে। তাতে প্রায় ৪৫ হাজার টাকা বিল করা হয়েছে। নতুন কম্পিউটার মেরামত দেখিয়ে ১০ হাজার টাকা বিল, ১৫০০ টাকার ওয়াইফাই রাউটার সাড়ে ছয় হাজার টাকায় ক্রয় দেখানো হয়েছে। এছাড়া আকাশচুম্বী দামে কম্পিউটার সামগ্রী ক্রয়, ৩০০ টাকার পাপোশ ১ হাজার টাকা দাম দেখানো হয়েছে। এছাড়াও শ্রমিক দিয়ে কাজ না করিয়ে নিজে সাক্ষর করে ৪০ হাজার টাকার  শ্রমিক মজুরি (অনিয়মিত) বিল ভাউচার করা হয়েছে। এমন ১০টি খাতে মালামাল ক্রয়ে ভুয়া ও বেশি দাম দেখিয়ে ভুতুড়ে বিল ভাউচার করে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন কলেজটির অধ্যক্ষ প্রকৌশলী মো. নুরুল হক।

৭০০ টাকা দামের এই ফুটবলটি কেনা হয়েছে ২৭০০ টাকায়।

কলেজটির ক্রয় কমিটির সদস্য উত্তম রায় বলেন, আমি ওই ক্রয় কমিটির সদস্য। অধ্যক্ষের কথায় আমি সদস্য হয়েছি। কিন্তু মালামাল ক্রয়ের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। অধ্যক্ষ নিজের মন মতো করে ঠিকাদারের কাছ থেকে এসব মালামাল ক্রয় করেছেন। ক্রয় কমিটির সদস্য হিসেবে আমাকে সাক্ষর করতে বলা হয়েছে। আমি সাক্ষর করেছি। মালামাল ক্রয়ের সময় আমি ছিলাম না।

ক্রয় কমিটির অন্য এক সদস্য ও কলেজের সহকারী শিক্ষক নওরোজ ইসলামের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কলেজের এক কর্মকর্তা বলেন, অধ্যক্ষ যোগদান করেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন মালামাল ক্রয়ে। তখন তিনি তাড়াহুড়ো করেই দুইটি ক্রয় কমিটি গঠন করলেন। একটি হলো টেন্ডারের মাধ্যমে মালামাল ক্রয় কমিটি। আর অন্যটি সরাসরি কলেজ কর্তৃপক্ষ ক্রয় কমিটি। দুই কমিটিরই প্রধান অধ্যক্ষ। এরপর দরপত্র আহ্বান না করেই নিজের নামমাত্র ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিভিন্ন খাতে মালামাল ক্রয় করেন।

তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন হোটেল থেকে খালি ক্যাশ মেমো সংগ্রহ করে তাতে বিরিয়ানি ও প্যাকেটের পরিমাণ দেখিয়ে বিল ভাউচার করে টাকা নিজের পকেটে ভড়েছেন। যার প্রমাণ রয়েছে, গাজীপুরের একটি হোটেল থেকে বেশ কয়েকবার বিরিয়ানি কেনা। আমার কথা হচ্ছে যেহেতু দুই মিনিটের পথ পাড়ি দিলেই বিরিয়ানির দোকান রয়েছে। সেখানে গাজীপুর থেকে বিরিয়ানি কিনে কেন আনতে হবে। এছাড়া তিনি ১৫০০ টাকার ওয়াইফাই রাউটার সাড়ে ছয় হাজার টাকা দাম দেখিয়েছেন। আর এসব খাতে আকাশচুম্বী দামে মালামাল ক্রয় করে কয়েক লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন অধ্যক্ষ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ প্রকৌশলী মো. নুরুল হক বলেন, যেহেতু ঠিকাদারের মাধ্যমে গাদি চুক্তিতে কেনা হয়েছে তাই কোনোটায় দাম বেশি ধরা হয়েছে আবার কোনোটায় দাম কম ধরা হয়েছে। বিল ভাউচারে প্রতিটি মালামালে তো দেখছি দাম বেশি কোনো মালামালে দাম কম ধরা হয়নি এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যক্ষ বলেন, তখন আমি খেয়াল করিনি, কিন্তু এখন দেখছি প্রতিটি মালামাল বাজারের চাইতে বেশি দাম ধরেছে। এখন আর কি করার কেনা তো হয়ে গেছে। তবে বিল ভাউচার দেখানোর আগে অধ্যক্ষ সবকিছু অস্বীকার করে বলেন, সব কিছুর দাম যাচাই বাছাই করে, কলেজের ক্রয় কমিটির মতামত নিয়েই কেনা হয়েছে।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ খসরুল কবীর বলেন, এটি রাষ্ট্রের অর্থ আত্মসাতের সুকৌশল। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আগে থেকেই চুক্তি থাকে এসব কর্মকর্তাদের। সেখান থেকে কয়েক শতাংশ অর্থ নিজের পকেটে নিয়ে নেয় সেই সব কর্মকর্তা। এটা রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় ও আত্মসাতের শামিল।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সভাপতি রবীন্দ্রনাথ অধিকারী বলেন, ভুয়া ভাউচার ও দাম বেশি দেখিয়ে ভুতুড়ে বিল ভাউচার করে যদি কোনো কর্মকর্তা অর্থ নিজের পকেটে ভরে তাহলে আমি মনে করি সেটা রাষ্ট্রের অর্থ আত্মসাতের শামিল। এমন বহু কর্মকর্তা রয়েছে যারা এমন বিল ভাউচার করে রাষ্ট্রের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি থাকবে এ সকল কর্মকর্তাদের দ্রুতই আইনের আওতায় আনার।

এএএ