ইনসেটে অভিযুক্ত ওসি কৃপা সিন্ধু বালা

ধর্ষণের বিচার চেয়ে গত বছর প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি দিয়েছিল বগুড়ার ধুনট উপজেলার এক স্কুলছাত্রী। মেডিকেল পরীক্ষায় ধর্ষণের প্রমাণ মেলে। আসামিও স্বীকারোক্তি দেন আদালতে। কিন্তু ধর্ষণের সময় ধারণকৃত ভিডিও নষ্ট করেন ধুনট থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কৃপা সিন্ধু বালা। সেটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। 

তবে ঘটনার দেড় বছর পার হলেও মামলা আর এগোচ্ছে না। ধর্ষণের আলামত নষ্ট করা সেই পুলিশ কর্মকর্তাও আছেন বহাল তবিয়তে। পাবনার সদর থানা ওসি হিসেবে কর্মরত আছেন। অন্যদিকে বিচারের জন্য মামলার চার্জশিটের আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন নির্যাতনের শিকার মেয়েটির বাবা-মা।

ধর্ষণের বিচার দাবিতে শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) বেলা ১১টার দিকে বগুড়া শহরের সাতমাথায় অবস্থান কমসূচি পালন করেন মেয়েটির মা। প্রায় এক ঘণ্টা তিনি সাতমাথায় অবস্থান করেন।

ওই স্কুলছাত্রীর মায়ের ভাষ্য, চার্জশিট মিলবে, তবে ধর্ষণের আলামত নষ্টকারী ওসি কৃপা সিন্ধু বালার নাম বাদ দিতে হবে- এমন শর্ত দেওয়া হয়েছে তাকে। এর প্রতিকার পেতে গত ১৩ সেপ্টেম্বর আইজিপির কাছে লিখিত আবেদন করেছেন তিনি। একই আবেদনের একটি অনুলিপি দেওয়া হয়েছে বগুড়ার পিবিআই কার্যালয়ে।  

মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের ৩ মার্চ বেলা ১১টার দিকে দশম শ্রেণির ওই স্কুলছাত্রীকে নিজ ঘরে নিয়ে ধর্ষণ করেন জালশুকা হাবিবর রহমান ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক মুরাদুজ্জমান। শুধু তাই নয়, ধর্ষণের কিছু আপত্তিকর ভিডিও মুঠোফোনে ধারণ করেন ওই প্রভাষক।

এমন অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ১২ মে সকালে ধুনট থানায় মামলা করেন ভুক্তভোগীর মা। মামলার পর ওইদিন সন্ধ্যায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯ মে প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি লেখে ওই স্কুলছাত্রী।

পরবর্তীতে ওই বছরের ২ আগস্ট ধুনট থানার তৎকালীন ওসি কৃপা সিন্ধু বালার বিরুদ্ধে ধর্ষণের আলামত নষ্ট করার অভিযোগ করেন ওই স্কুলছাত্রীর মা। তিনি বগুড়া জেলা পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তীর কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ দেন। কিন্তু অভিযোগের পর দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও তদন্ত শেষ না হওয়ায় অসন্তুষ্ট ওই স্কুলছাত্রীর মা।

একপর্যায়ে ২৮ আগস্ট মামলা ও ওসির বিরুদ্ধে আলামত নষ্টের অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব পিবিআইয়ের কাছে দেওয়ার দাবি জানান তিনি। তার দাবির প্রেক্ষিতে ওই বছরের অক্টোবরে মামলার দায়িত্বভার নেন পিবিআইয়ের পরিদর্শক সেলিম মালিক। পরবর্তীতে ১ নভেম্বর থেকে মামলার তদন্ত করছেন পিবিআইয়ের উপপরিদর্শক (এসআই) সবুজ আলী।

আর ওসি কৃপা সিন্ধু বালার বিরুদ্ধে আলামত নষ্টের অভিযোগটি দেখছেন পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার কাজী এহসানুল কবির। চলতি বছরের ৩০ মার্চ ওসির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় আইজিপির দপ্তরে প্রতিবেদন জমা দেয় পিবিআই। 

অভিযুক্ত ওসি কৃপা সিন্ধু বালা ২০২২ সালের ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত বগুড়ার ধনুট থানার দায়িত্বে ছিলেন। পরে রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি আব্দুল বাতেন স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে তাকে পাবনা জেলায় পাঠানো হয়। তিনি বর্তমানে পাবনা সদর থানায় ওসি হিসেবে কর্মরত আছেন। এ ঘটনার প্রায় পাঁচ মাস অতিবাহিত হলেও মামলার কোনো অগ্রগতি হয়নি। 

অবস্থান কর্মসূচিতে মামলার বাদী বলেন, কৃপা সিন্ধু বালার অপরাধগুলো প্রমাণ করে প্রতিবেদন দাখিল করেছে পিবিআই বগুড়ার কার্যালয়। তা সত্ত্বেও পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার উদ্ধারকৃত ফোন দুটি বিভিন্ন সময়ে একাধিক সংস্থায় ফরেনসিক করেছেন। ফরেনসিক শেষে ফোন দুটি এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে বগুড়া কার্যালয়ে পাঠানো হয়। খবর পেয়ে মামলার সার্বিক অবস্থা জানার জন্য আমি ৮ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টার দিকে বগুড়া পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার কাজী এহসানুল কবিরের কার্যালয়ে উপস্থিত হই। 

তিনি আমাকে জানান যে, পিবিআই বগুড়া ও পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার কর্তৃক ফরেনসিক রিপোর্টের ফলাফল একই এসেছে। সুতরাং পিবিআই বগুড়া কর্তৃক দাখিলকৃত প্রতিবেদনে কৃপা সিন্ধু বালাকে ফৌজদারি ও বিভাগীয় আইনের যে সমস্ত ধারায় অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়েছিল তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। কিন্তু দুঃখের বিষয় পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার মহোদয় মামলার মূল চার্জশিটে কৃপা সিন্ধু বালাকে বাদ রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। পুলিশ সুপার কাজী এহসানুল কবির আমাকে কৃপা সিন্ধু বালা ব্যতীত চার্জশিট নেওয়ার প্রস্তাব করলে আমি তা প্রত্যাখ্যান করে বাসায় চলে আসি।

তিনি আরও বলেন, বগুড়া জেলা পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তীর গঠিত তদন্ত কমিটি যেমন আমার উপস্থাপিত সমস্ত প্রমাণাদি আড়াল করে সিআইডির ফরেনসিক নির্ভর প্রতিবেদন দাখিল করেছিল, ঠিক তেমনি পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার মহোদয় মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে কৃপা সিন্ধু বালাকে মামলা থেকে রেহাই দেওয়ার তথ্য সম্পর্কে আমি অনেক আগেই অবগত হয়েছিলাম।

মামলা সংক্রান্ত নথিপত্র থেকে জানা যায়, ২০২২ সালের ১৪ মে স্কুলছাত্রীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। এর প্রায় দেড় মাস পর প্রতিবেদন দেওয়া হয়। এতে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক মিজানুর রহমান, প্রভাষক মাকসুদুর রহমান আকন্দ ও রোকসানা খাতুন স্বাক্ষরিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আমরা সবাই একমত যে এখানে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপনের একাধিক চিহ্ন রয়েছে।

মামলার বাদী স্কুলছাত্রীর মা বলেন, মামলার শুরু থেকে ওসি কৃপা সিন্ধু বালা আমাদের সঙ্গে অন্যায় করে আসছেন। সঠিক চার্জশিট দেওয়ার জন্য তিনি প্রায় ৫ থেকে ৭ লাখ টাকার ঘুষ দাবি করেছিলেন। বিভিন্ন সময়ে ১ লাখ ২২ হাজার টাকা ঘুষ নেন। এর মধ্যে ২০ হাজার টাকা ওসি কৃপা সিন্ধু বালা নিজেই নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে আসামি মুরাদের সঙ্গে আপস করে ধর্ষণের আলামত নষ্ট করেন তিনি। আলামত হিসেবে জব্দ মোবাইল ফোন বেআইনিভাবে নিজের হেফাজতে নিয়ে ওই সময় বগুড়া সদর থানা, ছিলিমপুর ফাঁড়ি, আদমদিঘী থানায় পাঠিয়েছেন। সর্বশেষ উনি প্রমাণস্বরুপ ভিডিওগুলো নষ্ট করেন।

ওই স্কুলছাত্রীর মা বলেন, ভিডিও নষ্টের বিষয়টি পিবিআই পুলিশ সুপার কাজী এহসানুল কবিরের তদন্তে প্রমাণিতও হয়েছে। সেই প্রতিবেদনও জমা দেওয়া হয়েছে। মামলার পরে মেডিকেল রিপোর্টেও ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া গেছে। আসামি জবানবন্দিও দিয়েছেন। তাহলে তো মামলার তদন্তের আর কিছু নেই। তারপরও চার্জশিট মিলছে না। কারণ জানতে গেলে কৃপা সিন্ধু বালার নাম বাদ দিয়ে চার্জশিট নেওয়ার কথা জানানো হয় আমাদের। এটা যদি হয় তাহলে তো মামলার আর কিছুই থাকলো না। অপরাধের বিচারের কিছুই থাকবে না।

টাকা নেয়া ও ধর্ষণ মামলার আলামত নষ্টের অভিযোগের বিষযে পাবনা সদর থানার বর্তমান ওসি কৃপা সিন্ধু বালা বলেন, সব বানোয়াট, মিথ্যা। তিনি বিভিন্ন জায়গায় এমন অভিযোগ করছেন। এগুলো আমাকে হয়রানি ও সম্মানহানির জন্য করছেন।

ধর্ষণ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সবুজ আলী বলেন, মামলার তদন্ত এখনো চলমান। শুনেছি মামলার আসামি মুরাদুজ্জামান জামিন পেয়েছেন। তবে আমার কাছে এ সংক্রান্ত কোনো নথি নেই।

তবে মামলার বাদীর অভিযোগ সত্য নয় বলে জানান পিবিআই বগুড়া কার্যালয়ের পুলিশ সুপার কাজী এহসানুল কবির। তার ভাষ্য, উনি কী মনে করছেন তা আমি জানি না। আমি কিন্তু এমন কোনো তথ্য দেইনি, যে কৃপা সিন্ধু বালা চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত হবেন না। তদন্ত এখনো চলমান। ধর্ষণের আলামত নষ্টের ঘটনায় বিভাগীয় তদন্তে আমরা কিছু পারিপার্শ্বিক প্রমাণ পেয়েছি। খুব শিগগিরই আমাদের তদন্ত শেষ হবে।

ধর্ষণ মামলার আলামত ধ্বংসের অভিযোগ ও প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ার পরও কৃপা সিন্ধু বালা এখনো একটি থানার ওসি হিসেবে কর্মরত আছেন। এ বিষয়ে কাজী এহসানুল কবির বলেন, এটি পুলিশ হেডকোয়ার্টারের বিষয়। তারা এটি দেখবেন। তবে অভিযোগকারী যাতে ন্যায়বিচার পান সেটি আমরা অবশ্যই দেখব।

পূর্বের ঘটনা

২০২১ সালের অক্টোবর মাস থেকে অভিযোগকারীর বাড়িতে ভাড়া ছিলেন প্রভাষক মুরাদুজ্জামান। এ অবস্থায় বাড়িওয়ালার অনুপস্থিতির সুযোগে তার ১৬ বছর বয়সী মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কিছু ছবি তোলেন তিনি। এসব ছবি ভাইরাল করে দেওয়ার ভয় দেখান মুরাদ। পরে ২০২২ সালের সুযোগ পেয়ে ৩ মার্চ বেলা ১১টার দিকে মেয়েটিকে নিজ ঘরে নিয়ে ধর্ষণ করেন। শুধু তাই নয়, ধর্ষণের কিছু আপত্তিকর দৃশ্যও মুঠোফোনে ধারণ করেন ওই প্রভাষক। পরে আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও ফেসবুকসহ অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে মেয়েটির সঙ্গে একাধিকবার ঘনিষ্ঠ হন তিনি। সর্বশেষ ২০২২ সালের ১২ এপ্রিল সকালে ভাড়া বাসায় মেয়েটিকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন মুরাদুজ্জামান। এ সময় মেয়েটির চিৎকারে স্বজনরা এগিয়ে এলে কৌশলে পালিয়ে যান প্রভাষক। পরে আর তিনি ওই বাসায় ফেরেননি।

তবে ওই ঘটনার পরপরই মুরাদুজ্জামানের পরিবারকে বাসা থেকে বের করে দেয় মেয়েটির পরিবার। এ ছাড়া গত ১২ মে সকালে ধুনট থানায় মুরাদুজ্জমানের বিরুদ্ধে মামলা করেন ভুক্তভোগীর মা। মামলার পর ওইদিন সন্ধ্যায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

মুরাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর গত ২৪ মে ধুনটের জালশুকা হাবিবর রহমান ডিগ্রি কলেজ পরিচালনা কমিটি তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে। আদালতের রায়ে তিনি দোষী প্রমাণিত হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তাকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় কলেজ পরিচালনা কমিটি।

আরএআর