‘পুতির বউরা ধরে মারতো, আর ছাবালরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতো। একবেলায় এক মুঠ ভাত খাতি দেতো তাও বড় বউ লাথি মেরে, চাইলে ভাতের থাল ফেলায় দেতো। ছোট ছাবাল মাঝে মধ্যি বাড়িতে আইসে লাঠি, চটা দিয়ে মারতো। আমার বুড়িডা (স্ত্রী) কোথাও কফ, থুথু ফেললে বড় পুতির বউ মাথা ঠাইসে ধরতো। ওরেও চুলির মুঠি ধরে মারতো। মারতি মারতি আমাগের আইধমরা বানায় ফেলাইছে।’

এভাবেই বুক ফাটা কষ্ট নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ছেলে ও ছেলের বউদের হাতে নির্যাতনের বর্ণনা দিচ্ছিলেন ৮৪ বছরের বৃদ্ধ বারিক গাজী। পাশে বসে চোখের পানি ফেলছিলেন তার অন্ধ স্ত্রী ৭৮ বছরের বৃদ্ধ শহর বানু। তারা যশোরের কেশবপুর উপজেলার গৌরীঘোনা ইউনিয়নের বুড়লী গ্রামের বাসিন্দা। তবে ছেলেদের নির্যাতনে বর্তমানে ঠাঁই হয়েছে একই গ্রামে তাদের মেঝো মেয়ে কোহিনুর বেগমের বাড়িতে।

এলাকাবাসী ও বৃদ্ধ বাবা-মায়ের মেয়েরা জানান, বারিক গাজীর দুই ছেলে ও পাঁচ মেয়ে। বারিক গাজী ও তার স্ত্রী তাদের বড় ছেলে সাজ্জাদ হোসেনের বাড়িতেই থাকতেন। একদিন বড় ছেলে সাজ্জাদ হোসেন ও ছোট ছেলে সাইদ হোসেন বারিক গাজীকে ডাক্তার দেখানোর কথা বলে কেশবপুরের রেজিস্ট্রি অফিসে নিয়ে টিপ সইয়ের মাধ্যমে বারিক গাজীর সব জমি লিখে নেন। এরপর থেকে বৃদ্ধ বারিক গাজী ও তার স্ত্রীর ওপর অমানবিক নির্যাতন শুরু করেন দুই ছেলে। সর্বশেষ ১০ দিন আগে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ঘর ভেঙে দিয়ে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দেয় তার দুই ছেলে ও পুত্রবধূরা। পরবর্তীতে রাস্তা থেকে তাদের ঠাঁই মেলে  মেজো মেয়ে কোহিনূর বেগমের বাড়িতে।

বৃদ্ধ বারিক গাজীর মেজো মেয়ে কোহিনুর বেগম বলেন, সপ্তাহখানেক আগে ভাইয়েরা তাড়িয়ে দেওয়ায় বৃদ্ধ বাবা ও মা আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। আমরা পাঁচ বোন বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে এর সুষ্ঠু বিচার ও ভাইয়েরা যাতে ভরণ-পোষণ দেয় তার দাবিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ দিয়েছি।

সরেজমিনে বারিক গাজীর বাড়িতে গেলে তার প্রতিবেশীরাও বৃদ্ধ বাবা-মাকে অমানবিক নির্যাতনের বর্ণনা দেন। দুই ছেলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং ভুক্তভোগী বৃদ্ধ বাবা-মায়ের জমি ও বাসস্থানে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা।

বারিক গাজীর ছোট ভাই বৃদ্ধ জলিল গাজী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বড় ভাই বারিক গাজীকে তার ছেলে ও ছেলের বউরা অনেক মারধর করতো। আমরা ঠেকাতে গেলে আমাদেরও মারতে আসতো। জায়গা জমি লিখে নেওয়ার পর থেকে নির্যাতন শুরু করে। কয়দিন আগে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা এই দুই ছেলের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই। 

অভিযোগের ব্যাপরে বারিক গাজীর বড় ছেলে সাজ্জাদ হোসেন বলেন, আমার বাবা আমার ছোট ভাইকে জমি লিখে দিয়েছে। আমি বলেছি, যে ছেলেকে জমি লিখে দিয়েছো সেই ছেলের কাছে গিয়ে থাকো। তখন আমার বাবা-মা স্বেচ্ছায় বাড়ি থেকে চলে গেছে। এ সময় তিনি তার বাবা-মাকে নির্যাতনের বিষয়টি অস্বীকার করেন।

গৌরীঘোনা ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার মোস্তাফিজুর রহমান কাজল বলেন, ওই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার দুই ছেলে ও পাঁচ মেয়ে। ছেলেরা ডাক্তার দেখানোর কথা বলে বারিক গাজীর ২৪ শতক জমি লিখে নিয়েছে। এ জমি নিয়ে কয়েক দফা সালিশ করেও মীমাংসা করা সম্ভব হয়নি। ওই বৃদ্ধ তার সহায় সম্পত্তি সন্তানদের নামে লিখে দিয়ে এখন নিঃস্ব হয়ে গেছেন। ছেলেরা ভরণপোষণ দেওয়া তো দূরের কথা, যে ঘরটায় তারা ছিলেন তার চালাও ভেঙে দিয়েছে। যা দুঃখজনক। 

এ বিষয়ে কেশবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এম এম আরাফাত হোসেন বলেন, ভুক্তভোগী বৃদ্ধ বাবা-মায়ের কাছ থেকে আমরা একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। উপজেলা সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) সরেজমিনে পরিদর্শন করতে পাঠিয়েছিলাম। তাদেরকে নোটিশ করা হয়েছে। শিগগিরই কাগজপত্র দেখে এটার একটা মীমাংসা করা হবে এবং এই বৃদ্ধ বাবা-মা যাতে কষ্ট না পায় সে বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

এ্যান্টনি দাস অপু/আরএআর