ছবি: মঙ্গলবার সকালে বগুড়া শহরের রাজা বাজার এলাকায়।

গত কয়েক বছরের মধ্যে এবার আলুর দাম গগনচুম্বী পর্যায়ে গেছে। সম্প্রতি বাজার নিয়ন্ত্রণে আলুর দাম বেঁধে দেয় সরকার। কিন্তু নির্ধারিত দাম প্রতি কেজি ২৭ টাকায় আলু পাচ্ছেন না পাইকারি ব্যবসায়ীরা। ফলে বগুড়ার বাজারগুলোয় বড় সাদা জাতের (স্টিক) আলুর সংকট দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে হিমাগারের ব্যবসায়ীরা বলছেন উল্টো কথা। তাদের ভাষ্য, আলু নিয়মিত সরবরাহ হচ্ছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা আলু বিক্রিতে কারসাজি করছেন।

এসব সংকট নিরসনে সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের সহায়তায় পাইকারি রাজা বাজারে ৩৬ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রির ব্যবস্থাও করা হয়। তবে এই ব্যবস্থায় আলু ক্রয় করে চাহিদা মেটাতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা।

বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এ বছর ৫৩ হাজার ২১৫ হেক্টর জমিতে ১০ লাখ ২৪ হাজার ১২০ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়। এর মধ্যে ১৪ হাজার হেক্টর জমিতে দেশীয় পাকড়ি, হাগড়াই জাতের আলুর চাষ করেন কৃষকেরা। বাকি জমিতে বিদেশি ও উফশী কার্ডিনাল, গ্রানোলা, ডায়মন্ড জাতের চাষ হয়েছে।  
প্রতি হেক্টর জমিতে ২৫ টন করে আলুর ফলন হয়েছে।

উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ফরিদুর রহমান জানান, বগুড়ার ৪২টি হিমাগারে মৌসুমের শুরুতে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টন আলু সংরক্ষণ ছিল। এখন পর্যন্ত প্রায় এক লাখ ৪২ হাজার মেট্রিক টন আলু সংরক্ষণ আছে বগুড়ার হিমাগারগুলোতে।

বগুড়ার পাইকারি মোকাম রাজাবাজার, খুচরার ফতেহ আলী, কলোনী বাজার ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ ব্যবসায়ীর কাছে স্টিক আলুর পরিমাণ খুব কম। দেশীয় পাকড়ি জাতের বা গোল ছোট আলু পর্যাপ্ত আছে। বগুড়ার বাইরে এগুলোর চাহিদা কম। জেলার ভেতরে পাকড়ি আলুর চাহিদা ও দাম বেশি। এখন খুচরা পর্যায়ে ভোক্তাদের প্রতি কেজি স্টিক আলু কিনতে হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়। আর পাকড়ি আলু প্রতি কেজি ৫২-৬০ টাকায়।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ বছরের মার্চে মৌসুমের শুরুতে কৃষকরা প্রতি কেজি আলু বিক্রি করেন ১০ থেকে ১২ টাকায়। জুলাই থেকে একটু করে বাড়তে থাকে আলুর বাজার।

চলতি সেপ্টেম্বর মাসে হিমাগারেই আলুর দাম ঠেকে প্রতি কেজি ৩৮ টাকায়। আরও বাড়তে পারে এমন ধারণায় অনেক ব্যবসায়ী হিমাগারেই আলু  কিনে নেন। এর পরপরেই সরকার ১৪ সেপ্টেম্বর দাম নিয়ন্ত্রণে আলুর মূল্য নির্ধারণ করে প্রতি কেজি ২৭ টাকা। কিন্তু ব্যবসায়ীরা ওই দামে আলু বিক্রি করলে প্রচুর টাকা লোকসানের মুখে পড়বেন। ফলে তারা আলুর সরবরাহ কমিয়ে দেন।

গত ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে রাজাবাজারের সরকার নির্ধারিত ৩৬ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করছেন চার জন ব্যবসায়ী। তাদের কাছে জানা যায়, বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য জেলা প্রশাসন ও কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তারা প্রতি কেজি ৩৬ টাকায় স্টিক আলু বিক্রি করছেন। একজন ভোক্তা সর্বোচ্চ ৫ কেজি আর ব্যবসায়ীরা ৫ বস্তা (৫০ কেজি) আলু ক্রয় করতে পারবে তাদের কাছ থেকে।  

এর মধ্যে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আলুর বাজারের অস্থির অবস্থা নিরসনে আমরা ৩৬ টাকা দরে বিক্রি করছি। তবে এতে আমাদেরও সমস্যা হচ্ছে। গতকাল ১৫ বস্তা আলু বেচে আমার ৮০০ টাকা ঘাটতি হয়েছে। কারণ বস্তায় পচা, নষ্ট আলু, ধুলাবালি ছিল।

এই বাজারের পাশের আরেক পাইকার মিলন শেখ বলেন, আমাদের এখানে প্রত্যেক ব্যবসায়ীর গড়ে অন্তত ২০ বস্তা স্টিক আলু লাগে। কিন্তু আমরা পাচ্ছি ৫ বস্তা করে। এখানে আমাদের ব্যবসা করার মতো অবস্থা নেই।

আব্দুস সোবহান নামে আরেক ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, হিমাগারে গেলে আলু কিনতে হবে ৩৫- ৩৬ টাকা দরে। ওরা ওখানে ঠিকই দেখাবে ২৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক বস্তা আলু নিয়ে আসতে খরচ হয় ৩-৪ টাকা। আবার আমাদের এখানে বেচতেও হবে ৩৬ টাকায়। বেশি দাম দিয়ে বেচলেও ম্যাজিস্ট্রেট ফাইন করবেন। কিন্তু আমরাতো সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে আলু পাচ্ছি না, বেচবো কীভাবে।

শহরের নামাজগড় এলাকার ভোক্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, খুচরা বাজারে আলুর দাম বেশি। কেজি প্রতি ৪০ টাকার মতো। এ জন্য পাইকারি বাজার থেকে আলু কিনলাম। প্রতি কেজি আলুর দাম নিয়েছে ৩৬ টাকা।  

তবে আলু সরবরাহের সংকটের কথা অস্বীকার করেন হিমাগার সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি, আলু নিয়মিত সরবরাহ হচ্ছে। সরকারি দামেই বিক্রি হচ্ছে। খুচরা ব্যবসায়ীরাই বেশি দামে বিক্রির উদ্দেশ্যে এমন কথা ছড়াচ্ছেন।

বগুড়া সদরের কাফেলা হিমাগারে আব্দুল বাছেদ নামে ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি নিজেও আলুর আবাদ করেন। আব্দুল বাছেদ বলেন, ২০২১ ও ২০২২ সাল লাগাতার আলুতে লোকসান দিয়ে এসেছি। এবার আমরা কিছুটা লাভের মুখ দেখেছিলাম। কিন্তু সরকার দাম বেঁধে দিল।

কৃষি কল হিমাগারের ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম বলেন, আমাদের হিমাগার থেকে প্রতিদিন ৫-৬ ট্রাক করে স্টিক আলু সরবরাহ হচ্ছে। এসব আলু চট্টগ্রাম, ফেনী, সিলেটে যাচ্ছে। আজকেও প্রায় দেড় হাজার বস্তা আলু বের হয়েছে। আসলে আলু সরবরাহ বন্ধ নেই। এটি খুচরা ব্যবসায়ীরা এমন সংকট দেখাচ্ছে। আর কয়েকদিন পর হিমাগারে আলু রাখার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। আলু আটকে রাখলে ব্যবসায়ীরা বিপদে পড়বে বেশি।

সরকারের নির্ধারিত ২৭ টাকা দামে আলু বিক্রিতে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হবে কিনা এমন প্রশ্নে সাইফুল ইসলাম বলেন, মৌসুমের শুরুতে খরচসহ প্রতি বস্তা (৬০ কেজি) আলু ক্রয় করেছেন ৯০০ টাকায়। প্রতি কেজির মূল্য ১৫ টাকা পড়েছে। হিমাগারের ভাড়া, শ্রমিকের মজুরি, নষ্ট আলু বাদ দিয়ে কেজিতে  আরও খরচ হয় ৫-৭ টাকা। এখন প্রতি কেজি ২৭ টাকা দরে বিক্রি করলে আয়-ব্যয় সমান হয়। এটি ৩০-৩২ টাকা কেজিতে বিক্রি করতে পারলে কৃষক-ব্যবসায়ী সব পক্ষই লাভবান হতো।

বাজারের এই পরিস্থিতি স্বীকার করেন রাজাবাজার আড়তদার ও ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক পরিমল প্রসাদ রাজ। তিনি বলেন, হিমাগারে দাম নিয়ে কিছু সংশয় আছে। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের বেশি নিতে পারেন কেউ কেউ। কিন্তু আলুর সরবরাহ বন্ধ নেই। আবার সব বাজারে অসাধু ব্যবসায়ী আছে। আমাদের রাজা বাজার ফতেহ আলী বাজারেও লোভী ব্যবসায়ী আছেন। সবসময় মনিটরিং করা সম্ভব হয় না।

এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বগুড়া কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ইফতেখারুল আলম রিজভী বলেন, মিলাররা (হিমাগার) আলুর বাজার নিয়ে কৃষক ও খুচরা ব্যবসায়ীদের মাঝে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এসব খবর আমাদের কাছেও আছে। এসব বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে আমাদের লোকবল কম থাকায় সময় লাগছে।

এএএ