ভয়াবহ নৌকাডুবির এক বছর
আজও থামেনি স্বজন হারাদের আর্তনাদ
পঞ্চগড়ের স্মরণকালের নৌকা ডুবির সেই দিন আজ। ২০২২ সালের আজকের এই দিনে (২৫ সেপ্টেম্বর) বোদা উপজেলার মাড়েয়া ইউনিয়নের করতোয়া নদীর আউলিয়া ঘাটে মহালয়ে যাওয়ার সময় ঘটেছিল নৌকা ডুবির ঘটনা। সে ঘটনায় ৭২ জনের মৃত্যু হলেও মরদেহ উদ্ধার হয়েছিল ৭১ জনের। একজন এখনো নিখোঁজ।
সে ঘটনায় কেউ হারান সন্তান, কেউ বাবা, কেউবা মা, কেউবা আপন বোন কিংবা নিকটাত্মীয়। আবার কেউ কেউ পরিবারে হারান তিন থেকে চারজনকে। স্বজন হারানোর শোক এখনো ভুলতে পারেননি পরিবারগুলো।
বিজ্ঞাপন
কী ঘটেছিল সেদিন
দুর্গাপূজার প্রাক্কালে দেবী দুর্গাকে আমন্ত্রণ জানাতে বোদা উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নের বদ্বেশরী মন্দিরে আয়োজন করা হয় বিশাল ধর্ম সভা। সে সভায় যোগ দিতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা করতোয়া নদী পার হতে আউলিয়া ঘাটে নৌকায় চড়েন তারা। নৌকায় ধারণক্ষমতার বেশি মানুষ ওঠায় সেটি কিছুদূর যেতেই ডুবে যায়। এ ঘটনায় কিছু লোক সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও নারী ও শিশুরা পানিতে ডুবে যায়। স্থানীয় লোকজনসহ ফায়ার সার্ভিস, দমকলকর্মীদের সহায়তায় একে একে উদ্ধার করা হয় ৬৯টি মরদেহ। কয়েকদিন পরে উদ্ধার হয় আরও দুজনের মরদেহ। নিখোঁজ থেকে যায় একজন। উদ্ধার হওয়া ৬৮ জনই সনাতন ধর্মের। তার একজন ছিলেন মুসলিম। তিনি ছিলেন সে নৌকার মাঝি। এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনায় শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে পুরো পঞ্চগড়।
স্বজন হারানোর আর্তনাদ
সেদিনের সে ঘটনায় একই পরিবারের চারজনকে হারান হেমন্ত রায়। স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের চার সদস্যকে হারানোর বেদনায় আজও কাতর তিনি। মা-বাবাসহ পরিবারের ছয় সদস্যকে হারান বামনহাট ইউনিয়নের বটতলী এলাকার উজ্জ্বল কুমার রায়। নৌকায় স্বামী হিমালয়ের সঙ্গে যাত্রী ছিলেন নববধূ বন্যা রানী। নিজেকে বাঁচলেও স্বামীকে হারিয়ে নির্বাক হয়েছিলেন তিনি। নদীপাড়ে হিমালয়ের বোন নীতি রানীর কান্না কাঁদিয়েছিল সবাইকে। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পাগলের মতো কেঁদে ছিলেন হিমালয়ের মা-বাবা। নৌকাডুবি ট্রাজেডিতে দুই মেয়েকে হারান কাজলদিঘী গ্রামের বাসিন্দা ধীরেন চন্দ্র।
দেবীগঞ্জের শালডাঙা হাতিডোবার পরিবারের পাঁচ সদস্যকে হারিয়ে ষাটোর্ধ্ব জলেশ্বরী রানীর গগন বিদারী আর্তনাদে স্তব্ধ হয়ে উঠেছিল পুরো এলাকা। মন্দিরে যাওয়ার সময় নৌকা ডুবে যাওয়ার সে দৃশ্য নিজ চোখেই দেখেছিলেন। পাঁচ বছর বয়সী দীপংকর ও দেড় বছরের নাতি বিষ্ণুর স্মৃতিচারণ করে বিলাপ করেছেন রাতভর। মা-বাবার সঙ্গে মহালয়া দেখতে যাচ্ছিল তিন বছর বয়সী দীপু। নৌকাডুবিতে নিজে বেঁচে ফিরলেও মা রুপালি রানী ফিরেছেন লাশ হয়ে। বাবা ভুপেন্দ্র নাথ থাকে নিখোঁজ। বাবাকে খুঁজে পেতে ঘাটে প্রহর গুনে সে। এভাবেই স্বজন হারিয়েছেন অনেকে। ঘটনার বছর ঘুরে এলেও তাদের চোখের সামনে সেই নৌকা ডুবির ঘটনায় স্বজনদের হারানোর শোক ভুলতে পারছেন না তারা। কেউ কেউ পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে বিপাকে পড়েন।
মা-বাবাসহ পরিবারের ছয় সদস্যকে হারানোর শোক এখনো ভুলতে পারেননি মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের বটতলী এলাকার উজ্জ্বল কুমার রায়। তিনি জানান, সেদিন নৌকা ডুবিতে বাবা-মা, পিসি, মাসি, নানা ও নানার বেয়াইকে হারিয়েছি। বাবা-মায়ের কথা মনে হলেই ছবি হাতে নিয়ে হাত বুলিয়ে মনকে সান্ত্বনা দেই। আমি এখনো লেখাপড়া করছি। ভাইসহ নিজের লেখাপড়ার খরচ, সংসারের খরচ, কৃষিকাজ সবই দেখতে হয় আমাকে। সামনের দিনে কীভাবে চলব সেই চিন্তায় ভেবে কূল-কিনারা পাই না।
পরিবারের প্রধানকে হারিয়ে এখন সংসারের হাল ধরেছেন ফুলমতি রানী। স্বামীকে হারিয়ে জীবনের খেই হারিয়ে ফেলেছেন। গত এক বছরে কেউ খোঁজ নেয়নি বলে আক্ষেপ তার। দুই সন্তান ও শাশুড়িকে নিয়ে কষ্টে চলছে জীবনযুদ্ধ।
নৌকা ডুবির ৭২ জনের মধ্যে এখনো নিখোঁজ সাকোয়া ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া এলাকার শান্তি রানীর স্বামী সরেন্দ্রনাথ রায়। স্বামীর ছবি নিয়ে এখনো বিলাপ করছেন তিনি। মানুষটা সেদিন দুপুরে সাইকেল নিয়ে ছোট্ট বেয়াইসহ মহালয়ার অনুষ্ঠানে গেলেন। একদিন, দুদিন এভাবে বছর হয়ে গেল, এখনো মানুষটাকে আর ফিরে পেলাম না।
নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা
নৌকা ডুবিতে নিহত পরিবারের সদস্যদের সরকারি, বেসরকারিভাবে, রাজনৈতিক দল থেকে আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়ানো হয়। জেলা প্রশাসন, রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন, পঞ্চগড়-১ আসনের সংসদ সদস্য মজাহারুল হক প্রধান, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নাঈমুজ্জামান মুক্তা ব্যক্তিগতভাবে, বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্নভাবে সহায়তার জন্য এগিয়ে আসেন। নগদ অর্থ ও খাদ্য সামগ্রী বিতরণের সময় তথ্যমন্ত্রী, ধর্মমন্ত্রী ও স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী ঘটনা পরিদর্শন ও নিহতদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করে সমবেদনা জানিয়েছিলেন।
ঘটনার তদন্ত ও মামলা
করতোয়ায় নৌকা ডুবির ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক দীপঙ্কর রায়কে তদন্ত কমিটির প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করে জেলা প্রশাসন। তদন্ত কমিটির প্রধান জানিয়েছিলেন, অতিরিক্ত যাত্রী চাপের কারণেই নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটে। সে ঘটনায় তিন কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও সে রিপোর্ট আজও প্রকাশ করা হয়নি।
নৌকা ডুবির ঘটনায় চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের মুখ্য পরিদর্শক শফিকুর রহমান বাদী হয়ে ঘাট ইজারাদার আব্দুল জব্বার, মাঝি বাচ্চু মিয়া ও মাঝি রবিউল ইসলামকে অভিযুক্ত করে ঢাকার চিফ মেট্রো পলিটনম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে মামলা করেন। মামলায় বলা হয়, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নৌযানের আকার-আকৃতি বিবেচনায় ধারণ ক্ষমতার বেশি যাত্রী বহন, নৌযানের বৈধ, চালক রেজিস্ট্রেশন ও সার্ভে সনদ না থাকা, নৌযানে সনদধারী মাস্টার, সুকানিও গ্রিজারনা রেখে নৌযান চালানো, ইজারা চুক্তি মোতাবেক নিরাপত্তা সামগ্রী ও জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম না রাখা এবং চালকের অদক্ষতাকে দায়ী করা হয়। ঘটনার ছয়মাস পর ১৪ মার্চ মামলার আসামি ঘাট ইজারাদার আব্দুল জব্বার ও ঘাটের মাঝি (নৌকাচালক) বাচ্চু মিয়াকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে আদালতের মাধ্যমে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়।
এদিকে নৌকা ডুবির এক বছর হওয়ায় মৃতদের আত্মার শান্তি কামনায় স্বজনদের আয়োজনে প্রতিটি বাড়িতে ২৫ সেপ্টেম্বর প্রার্থনা করা হবে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন বোদেশ্বরী মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক মদন মোহন রায়। তিনি জানান, এবারের মহালয়ার দিন বোদেশ্বরী মন্দিরে মন্দির কমিটির উদ্যোগে মৃতদের আত্মার শান্তি কামনায় শেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে।
পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, নৌকাডুবির পর নিহতদের পরিবারের সদস্যদের সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন অর্থসহ বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। আমরা মৃতদের পরিবারের সদস্যদের স্বাবলম্বী করার পাশাপাশি তাদের নিয়মিত খোঁজখবর রাখছি।
এসএম