হরসুন্দরী মরে প্রমাণ করেন তিনি ‘নির্দোষ’
জমিদারিত্বের বিরোধ নিয়ে হত্যা হন স্বামী কালী প্রসন্ন কুমার। মৃতের পরিবার সন্দেহ করে কালী প্রসন্ন কুমারের স্ত্রী হরসুন্দরী বিষ প্রয়োগ করে স্বামীকে হত্যা করেছেন। হরসুন্দরী বারবার অস্বীকার করেও পরিবারের কেউ বিশ্বাস করাতে পারেননি যে তিনি স্বামীর হত্যাকারী নন। তাই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণিত করতে স্বামীর চিতায় ঝাপ দেন তিনি।
সেদিন চিতায় পুড়ে অঙ্গার হয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করেছিলেন হরসুন্দরী। ঝালকাঠির কীর্তিপাশায় জমিদার বাড়ির ১৮২৮ সালে ঘটে যাওয়া হৃদয়বিদারক এই কাহিনী আজও মানুষকে শিহরিত করে। জমিদার বাড়িতে ঘটে যাওয়া এমন ঘটনার সূত্র ধরে বরিশালকে বলা হয় সতিদাহ প্রথার দেশ।
বিজ্ঞাপন
প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ দেখতে আসেন এই ভগ্নদশায় থাকা জমিদার বাড়িটি। স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মীদের আন্দোলনের ফলস্বরূপ হরসুন্দরীর সহমরণের কূপ সংরক্ষণ করে জেলা প্রশাসন। এর মধ্য দিয়ে উনিশ শতকের সমাজ ব্যবস্থা সর্ম্পকে ধারণা পায় এই প্রজন্ম।
গবেষক ও গণমাধ্যমকর্মী পলাশ রায় বলেন, শেক্সপিয়রের ট্রাজিক উপন্যাসের চেয়েও ট্রাজেডিপূর্ণ ছিল ঘটনাটি। এটি বরিশাল বিভাগের একমাত্র সমাধি যা সতিদাহের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে টিকে আছে। কীর্তিপাশার জমিদারেরা উপমহাদেশে নানাভাবে আলোচিত। তাদের উল্লেখযোগ্য অবদানও রয়েছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বিক্রমপুর পোরাগাছার রাজা কৃষ্ণ রাম এই অঞ্চলে আসেন। ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে তিনি জলাশয় ও বনভূমি তালুক নিয়ে জমিদারি স্থাপন করেন।
তার দুই ছেলে কৃষ্ণ কুমার সেনগুপ্ত ও দেবীচরণ সেনগুপ্তের জন্য নির্মাণ করেন দুটি বাড়ি। একটি পূর্ব বাড়ি অপরটি পশ্চিম বাড়ি। পরে তা দশ আনা বড় হিস্যা ও ছয় আনা ছোট হিস্যা জমিদার বাড়ি নামে পরিচিতি পায়। কালের পরিক্রমায় ছোট হিস্যার কোনো চিহ্ন আজও পাওয়া যায়নি। তবে ভগ্নদশায় থাকা নাট মন্দির, হলঘর, ছোট মন্দির, শানবাধান পুকুর নিয়ে এখনো টিকে আছে বড় হিস্যা। সেখানে এখন তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চালাচ্ছে।
দেবীচরণ সেনগুপ্তের প্রপৌত্র ছিলেন কালী প্রসন্ন কুমার। ১৮২৮ সালে হরসুন্দরী দেবী তার স্বামী কালী প্রসন্ন কুমারের মরদেহের সঙ্গে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার গ্যারেটের সামনেই চিতায় ঝাপ দেন। এর সাত বছর পরে ১৮৩৫ সালে বেন্টিঙ্ক সতীদাহ প্রথা আইন করে নিষিদ্ধ করেছিলেন। মৃত্যুকালে কালী প্রসন্ন কুমারের বয়স ছিল ২২ এবং তার স্ত্রী হরসুন্দরী ছিলেন ১৬ বছরের। কালী প্রসন্নের সমাধিতে তার স্ত্রীর সহমরণের ঘটনার পর এই অঞ্চলে আর এমন ঘটনা জানা যায়নি।
পলাশ রায় বলেন, এটি একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। আমরা জেলা প্রশাসনের কাছে দাবী জানিয়ে আসলে ১৯৯৬ সালে দাহের সেই স্থানটি বাধাই করে সংরক্ষণ করা হয়। সহমরণের স্মৃতিচিহ্নটি মূল জমিদার বাড়ির কিছুটা পূর্ব দিকে। সেখানে এখন কয়েকটি কামার পরিবার বসবাস করেন। তারা জানিয়েছেন, জমিদারের প্রজা ছিলেন তারা। জমিদারি বিলুপ্তির আগে কামারদের ওই বাড়ির জমি দিয়েছিলেন। সেই সূত্রে তারা বসবাস করছেন।
কবি আসমা চৌধুরী বলেন, জমিদার বাড়িতে সংরক্ষিত সহমরণের এই স্মৃতিচিহ্নটি আরও ভালোভাবে সংরক্ষণ করা উচিত। এই স্মৃতিচিহ্ন আমাদের ও আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে একটি শিক্ষনীয় বিষয়। আমরা কেমন সময় অত্রিকম করে এসেছি, নারীর প্রতি পূর্ববর্তী সমাজ কেমন আচরণ করেছে তা এসব নির্দশন থেকে আমরা জানতে পারি। এগুলো সংরক্ষণ করা হলে পরের প্রজন্ম একটু হলেও পেছনের ইতিহাসের প্রতি সন্ধিৎসু হবে এবং অতীতের সাথে সমকালকে তুলনা করার সুযোগ পাবে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সহমরণের চিতাটি ইট-সিমেন্টে বাধাই করে সংরক্ষণ করা হলেও বাড়ির বাসিন্দারা সেটিকে যেমন খুশি তেমনভাবে ব্যবহার করছেন। সবজি চাষ, ঘরের ফেলে দেওয়া কাপড় ঐতিহাসিক এই নির্দশনে ঝুলিয়ে শুকাচ্ছেন। তাছাড়া বাড়ির কেউ এই নিদর্শন সর্ম্পকে কাউকে জানাতেও আগ্রহী নন।
কীর্তিপাশা জমিদার বাড়িটি আনুমানিক উনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে প্রতিষ্ঠা হয়। বিংশ শতকে জমিদার বংশের দুজন বিখ্যাত ব্যক্তি হলেন রোহিণী রায় চৌধুরী ও তপন রায় চৌধুরী।
উল্লেখ্য, সতিদাহ প্রথাটি রাজা রামমোহন রায়ের উদ্যোগে ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর নিষিদ্ধ করা হয়। ইতিহাসবিদ সিরাজ উদ্দীন আহমেদ তার বরিশাল বিভাগের ইতিহাস গ্রন্থে কীর্তিপাশা জমিদার বাড়ির সন্তান তপন রায় চৌধুরীর ‘রোমন্থন’ গ্রন্থের বরাতে লিখেছেন ১৮৩৫ সালে বেন্টিঙ্ক সতীদাহ প্রথা আইন করে নিষিদ্ধ করে। তপন রায় চৌধুরীর ঠাকুরমায়ের চিতায় ঝাপের বিষয়টি শ্লেষের সাথে তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরকে